সোমবার, ০২-অক্টোবর ২০২৩, ০৫:৫৭ অপরাহ্ন

ডোমুরুয়া থেকে সচিবালয়

shershanews24.com

প্রকাশ : ১৭ আগস্ট, ২০২১ ০২:৪৮ অপরাহ্ন

সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজের সৌজন্যে, গত সংখ্যার পর: করোনা-অফিসিয়াল নাম কোভিড-১৯। চীনের উহান প্রদেশে গত বছর ডিসেম্বরের শেষ দিকে এ ভাইরাসের আক্রান্তের খবর হয়। তারপর আস্তে আস্তে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তখন আমাদের টনক নড়েনি। সরকার তখন মুজিব জন্মশতবর্ষ পালনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। ক্ষণ গণনা শুরু হলো, আর এতদিন, এত ঘণ্টা, এত মিনিট, এত সেকেন্ডÑ কত কত ইলেকট্রনিক ক্ষণ গণনার বোর্ড যত্রতত্র, সর্বত্র। আওয়ামী লীগ একাধারে তিন তিনবার ক্ষমতায় আছে। ২০০৮-সালের ডিসেম্বরে সর্বশেষ তত্ত্ববাধয়ক সরকারের অধীনে, তখনকার সেনাসমর্থিত সরকারের আমলে, আমি বলি সেনা নির্দেশিত সরকার-জাতীয় নির্বাচনে (শামসুল হুদা কমিশন) আওয়ামী লীগ (আলী) প্রকৃত ভোটে, ২০১৪ বিনা ভোটে, ১৫৩ আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, আর ২০১৮-এর ৩০ ডিসেম্বর ‘সিলমারার’ ভোটে ক্ষমতায় আসে। তার আগে ১৯৭৫ ক্ষমতা হারানোর ২১ বছর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার হাবিবুর রহমানের আমলে ১৯৯৬ সরকার গঠন করলেও সন্ত্রাসের জন্য আবার পরের ভোটে হেরে যায়। পরের ভোটে বিচারপতি লতিফুর রহমান সরকারের অধীনে আবার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বাজাদ) অর্থাৎ খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসে। ধারাবাহিকভাবে তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় আলী সরকার বেশ উন্নয়ন করছে, এটা অস্বীকারের উপায় নেই। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ বেশকিছু মেগা প্রজেক্ট এগিয়ে নিচ্ছে। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার সাহস আছে বটে, শেখের বেটি। কিন্তু দেশে গণতন্ত্রের বারোটা বাজিয়ে ফেলেছে। সুশাসন নির্বাসনে চলে গেছে বলা যায়। শেখ হাসিনার একক নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে, আবদুল গাফফার চৌধুরীর ভাষায় শেখ হাসিনার ‘কর্তৃত্ববাদী’ শাসন। মুজিববর্ষ পালনের ঢামাঢোলের মধ্যে করোনার প্রতি আগাম মনোযোগ দেয়া হয়নি বলতেই হয়। ৮ মার্চ প্রথম শনাক্তের এবং ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর পর ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি এবং লকডাউন দেয়া হলেও তা খুবই ঢিলেঢালা ছিল। করোনা নিয়ে আমি ৩টি লেখা লিখলাম যুগান্তরে যথাক্রমে ৩০ মার্চ, ১১ এপ্রিল এবং ৭ মে। শিরোনাম যথাক্রমে ‘করোনা ডরোনা’, ‘আনন্দে আছি, কিন্তু কেঁদে ফেললাম যে!’ এবং ‘বেঁচে থাকাটাই শেষ কথা’। মাঝে গার্মেন্টস খুলে আরেক লেজেগোবরে অবস্থার সৃষ্টি করা হলো। দফায় দফায় সাধারণ ছুটি বাড়িয়ে অবশেষে ৬৬ দিন পর জীবন-জীবিকার স্বার্থে ৩০মে থেকে আবার সব খুলে দেয়া হলো। কিন্তু মাঝখানে বড় বড় অনেক ডাক্তারও করোনায় মারা গেলেন। তবে জীবিকার জন্য সব খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত সমর্থনযোগ্য। দুর্ভিক্ষে মরার চেয়ে রোগে মরা অনেক ভালো। আলীর ১৯৭৪-এর কথা নিশ্চয় মনে আছে। ১৬ কোটি মানুষের দেশে মৃত্যুর সংখ্যাকে অস্বাভাবিক বলা যায় না।

আমার কিবরিয়া ভাইয়ের সাথে ঈদের দিনও কথা হলো। পরের দিনও হলো। তিনি আক্ষেপ করে বললেন যে, এই প্রথম তিনি ফেনীর বাড়িতে ঈদ করতে যাননি। কারণ করোনা, ঘরে থাকেন। তখনো তিনি করোনা আক্রান্ত হয়েছেন তা জানতেও পারেননি। ভাবী এক মেয়ের সাথে আমেরিকায়। বাসায় পুত্র এবং পুত্রবধু থাকনে জানালেন। হঠাৎ করে ৫/৬/২০ তারিখে চ্যানেল আই টেলিভিশনের স্ক্রলে তার মৃত্যু-সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে মর্মে আমাদের তেমুহানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা আফজাল ভাই জানালেন। পরে বিস্তারিত জানলাম যে, তিনি বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২-৪৫ মি. ঢাকা মেডিকেল কলেজে করোনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। আফজাল ভাইও জানাতে পারলেন না। টেলিভিশনেও তার জানাজার সংবাদ জানানো হলো না, ছুটে গেলাম তার কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডের পাশে ধানমন্ডিস্থ লেকের পাড়ের বাসায়। আগেও একবার গিয়েছিলাম। দারোয়ানরা কোনো তথ্যই দিতে পারলেন না। বাসায় যেতেও দিলেন না। আফজাল ভাইকে আবার টেলিফোন করলাম। ততক্ষণে তিনি কিবরিয়া ভাইয়ের বড় ভাইয়ের এক শ্যালিকা থেকে জানতে পেরেছেন যে, রাতেই কিবরিয়া ভাইকে ফেনীতে নেয়া হয়েছে এবং সকাল ৯টার দিকে ফেনীতে তার নিজ বাড়িতে জানাজা হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে। স্মৃতিতে ভেসে উঠল, কিবরিয়া ভাই আমার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ক্লিনিক ভবনের দোতলার কক্ষে প্রবেশ করলেন।
আমার অপারেশনের পর থেকে তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। কোন রোগী নিয়ে সমস্যা হলেই তার পরামর্শ নিতাম। ইউরোলজির রোগী হলেতো তার কাছেই পাঠিয়ে দিতাম। জোর খাটাতাম। আমার কিবরিয়া ভাইয়ের কাছে আবার কিসের অ্যাপয়েন্টমেন্ট। মাঝে মাঝে কপট রাগের ভাব দেখালেও দেখে দিতেন। আমার শ্রেণি-সাথী রামচন্দ্রপুরের আবদুল হকের (পরে ভারপ্রাপ্ত জেলা শিক্ষা অফিসার হিসেবে কক্সবাজার থেকে অবসরপ্রাপ্ত) শ্বশুরপক্ষীয় হবিগঞ্জের এক রোগীর শমরিতা হাসপাতালে অন্য সার্জনের অধীনে অপারেশন স্থির হয়। ১২টায় অপারেশন হবে, রোগীর অবস্থা গুরুতর। বাঁচে কি মরে অবস্থা। ১০টার দিকে অপারেশনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। এমন সময়ে হক সাহেব আমাকে টেলিফোনন করলেন এ অবস্থায় কী করা হবে। আমার তো দৌড় তখন মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। কিবরিয়া ভাইকে ফোন করলাম। ব্যস্ত, বড় প্রফেসর, টেলিফোনে পাওয়াও কষ্টকর। তবে কিবরিয়া ভাই এক বিরল ভদ্রলোক। প্রথম সুযোগেই আমাকে টেলিফোন ব্যাক করলেন। ঢাকার প্রাক্তন ডিসি মরহুম নিজামউদ্দিন টেলিফোন ব্যাক করার জন্য খ্যাত ছিলেন। এগারোটার দিকে তিনি টেলিফোন করলেন। অবস্থা তাকে জানালাম। তিনি খানিক চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, বদি ভাই, আমাদের ডাক্তারদের একটা ইথিকস্ আছে, আমার এক সহকর্মী অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সব রেডি, এ শেষ মুহূর্তে আপনার নিকট শুনে এবং রোগী না দেখে আমার পক্ষে মতামত জানানো কি ঠিক হবে? জোরাজোরি করলাম, কথা দিলাম, আপনার নাম বলব না। আপনি হলে এ রোগীকে কী করতেন তা বললেই হবে। এ উপকারটুকু শুধু করেন। আমার ফুপাতো ভাবীর বেলায় গোলাম রসুল স্যার যে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন, দেখি কিবরিয়া ভাই একইরকম মতামত জানালেন। বললেন, আমার রোগী হলে তাকে অপারেশনের কষ্ট দিতাম না। বাড়ি নিয়ে যেতে বলতাম, দু’চারমাস যা বাঁচে বাঁচতে দিতে বলতাম। আমি সাথে সাথে হক সাহেবকে জানালাম। তারা অপারেশনে গেলেন না। মাস দেড়েক পর রোগী মারা গেলেন। পরে কিবরিয়া ভাইকে ওই রোগীর মৃত্যু সংবাদ জানালাম। গোলাম রসুল স্যারের প্রসঙ্গও উঠালাম। তিনি বললেন, আমরাতো গোলাম রসুল স্যারের ছাত্র না শুধু, শিষ্যও। আপনি এখন গোলাম রসুল স্যার কোথায় পাবেন। আমি বললাম, কিবরিয়া ভাইকে, আমার কিবরিয়া ভাইকেতো পেলাম। উনি হেসে দিলেন, বললেন, দোয়া করবেন যেন আপনাদের বিশ্বাস এবং আস্থা ধরে রাখতে পারি। আজ মনে পড়ে, কত গরিব রোগীকে তাকে দিয়ে বিনে ফি-তে দেখিয়ে দিয়েছি। তিনি নিজ থেকে অনেক গরিব রোগীকে ওষুধের টাকাও দিতেন। একবার তিনি ভাবীসহ আমার ধানমন্ডির ৭নং রোডের সরকারি বাসায় গিয়ে হাজির। কথা প্রসঙ্গে তার এক মেয়ের বিয়ে নিয়ে একটা ইঙ্গিতপূর্ণ আগ্রহ প্রকাশ করলেন। কিন্তু যার জন্য আগ্রহ, সে তো তখন অন্যখানে হাবুডুবু খাচ্ছিল। পরে তো তার ছেলেমেয়ের বিয়েতে আমি গিয়েছি। 

আমার মনে পড়ে, আমার আব্বাতো প্যারালাইজ্ড অবস্থায় বাড়িতে। একবার তাকে বললাম, কিবরিয়া ভাই, আপনি তো সব ঈদ ফেনীর বাড়িতে করেন, একবার কি আমার আব্বাকে একটু দেখে আসবেন? মাঝে মাঝে তার প্রসাবের সমস্যা হয়। তিনি রাজি হলেন এবং আমার সাথে আমার আব্বাকে দেখার জন্য রিকশায় মহিপাল থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে আমাদের বাড়ি গেলেন। ফেরার সময় আমি আবার তাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে এগুলে তিনি থামিয়ে দিয়ে বললেন, এত ফরমালিটি করলে আপনি আমাকে কিবরিয়া ভাই বলেন কেন। আজ তাকে নিয়ে লিখতে আমার বড় কান্না পাচ্ছে। 

আমি তখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান। আমার খালাতো ভায়েরা-মঞ্জু আপার বর, স্কয়ার হাসপাতালে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে মরণাপন্ন, চিকিৎসায় একটু ভুলও নাকি হয়ে গিয়েছিল। একটা ইনজেকশন দিতে নাকি কী একটা অনিয়ম হলে সাথে সাথে তার মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে থাকে এবং তিনি নির্জীব হয়ে পড়েন। আমাকে খবর দিলেন মঞ্জুআপা, আমরা সংক্ষেপে মঞ্জুপা ডাকতাম। তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিবিড় পরিচর্চা কেন্দ্রে অর্থাৎ ইনটেনসিভ কেয়ারে নেয়ার আগ্রহ দেখালেন। আমি দুলাভাইকে দেখে চিনতে পারলাম না, কেমন হয়ে গেল মুখমন্ডল। একটা বড় ক্ষমতায় থাকলে এবং সময়টা অনুকূলে হলে তখন সব সহজে হয়ে যায়। আমি ওখানকার এক ডাক্তারের সাথে আলোচনা করলাম। তার বক্তব্য হলো, প্রচণ্ড দৈহিক নির্যাতনে তার অবস্থা শোচনীয় হয়েছে। আগেও তার হার্টের এবং কিডনির কিছু সমস্যা ছিল। ডায়াবেটিসতো ছিলই। নির্যাতনের পর দেহের মূল অনেক অঙ্গের অবস্থা চরমভাবে খারাপ হয়ে যায়। মঞ্জুপা বা দুলাভাই, এমনকি আমার শ্বশুরবাড়ির কেউ আমাকে এ নির্যাতন সম্পর্কে কিছুই বলেননি। ঘটনার সময়েও জানাননি। আমার শ্বশুরবাড়ির কাউকেও হয়তো জানানো হয়নি। মানসম্মানের বিষয় চিন্তা করে তারা হয়তো বিষয়টি গোপন রেখে দিয়েছিল। দুলাভাই জমিজমা কেনাবেচার কিছু কাজ করতেন। আমাকেও এক সময়ে এয়ারপোর্টের দিকে কিছু জায়গা কেনার জন্য বলেছিলেন। তারা দুজন আমার বেশ আপনজন ছিলেন শ্বশুরপক্ষের আত্মীয়ের মধ্যে। বস্তুত আমার বিয়ের পর আপন শ্বশুরবাড়ি ছাড়া মঞ্জুপা এবং দুলাভাইই আমার ওপক্ষীয় আত্মীয়ের মধ্যে যাতায়াতের এবং যোগাযোগের একটা ঠিকানা হিসেবে ছিলেন। তাদের রাজাবাজার, তেজগাঁও থানার পাশের এবং তেজগাঁও রেলস্টেশনের নিকট করা খালুর এবং পরে দুলাভাইয়ের নিজের বাড়িতে আমি বেড়িয়েছি। বিয়ের পরপর স্ত্রী নিয়ে বেড়ানোরর জায়গা আমার আর ঢাকায় তেমন ছিল না। বন্ধুবর সালেহ আহমদের বাসা, তার বন্ধু মোজাম্মেলের (এখন আমেরিকায়) বাসায়, আমার এক মামাতো ভাই আইয়ুব খানের বাসায় নতুন স্ত্রী নিয়ে গিয়েছি।

আইয়ুব ভাই জায়লস্কর স্কুলে আমার এক বছরের সিনিয়র, আমার বড় ফুপুর ছেলে গোফরান ভাইয়ের ক্লাসমেট। বিয়ের আগে থেকেই, এমনকি স্কুল জীবনের সময় থেকেই এ ভাইয়ের সাথে আমার যোগাযাগ ছিল। আমার নানার বাড়ির মূল বাড়ি সিন্দুরপুর পাটোয়ারি বাড়ি। তখনকার এবং এখনকারও, একটা নামকরা বাড়ি। আমার নানা পরে সিন্দুপুর, কেউ কেউ সাদেকপুরও বলতেন, বাজারের ঠিক পশ্চিম পাশে নতুন বাড়ি করে চলে আসেন। আমরা ছোট থাকতে থেকেই এ বাড়িতেই আসতাম। মায়ের জন্মও এ বাড়িতেই হয়েছে। আমার নানা-নানিকে আমার মনে নেই। মায়ের কাছে শুনেছি, নানা আমি ছোট থাকতেই মারা গেছেন। নানি মারা গেছেন তারও আগে। আমার নানারও দুই বিয়ে ছিল। প্রথম নানি মারা যাওয়ার পর দ্বিতীয় নানির ঘরেই আমার মায়ের জন্ম। নানির প্রথম পক্ষের ঘরে দুই মামা ছিলেন, আমরা বড় মামা আর ছোট মামা ডাকতাম। অনেক বড় হওয়ার পর এ ঘটনা জেনেছি। আমার বড় মামির আদরস্নেহ আমরা কোনোদিন ভুলব না। মাতৃকুলের ওই মামি, মামার মৃত্যুর পরও, অনেক বছর বেঁচেছিলেন। আমরা বেশ বড় হওয়ার পরও মামাবাড়ি গেলে মামি কোলে বসাতেন। বলতাম, মামি আপনি পড়ে যাবেন তো। আমার মা যে মামাদের সৎ বোন ছিলেন তা আমরাও বুঝতাম না। আমাদের সাথে মামাবাড়ির সম্পর্ক এখনো নিবিড়। বড় মামার এক ছেলে, এক মেয়ে। মামাতো বোন রহিমা এবং মামাতো ভাই মোহাম্মদ আইয়ুব (আইয়ুব খান ভাই নন) দু’জনই আমার বড়। আইয়ুব ভাই হয়তো মাস ছয়েক বড় হবেন। মামার বাড়ির স্মৃতি-কথায় পরে আসি। এখন আইয়ুব খান ভাইয়ের সাথের সম্পর্কটা শেষ করি।

আইয়ুব খান ভাই জায়লস্কর স্কুল থেকে (পূর্বে নামছিল জয়লস্করা, আমরা এ নামেই ভর্তি হয়েছি, পড়েছি, বর্তমানে জায়লস্কর নামে চলছে) এসএসসি পাসের পর ঢাকার জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হলেন। আমাকে পোস্ট কার্ডে চিঠি লিখতেন। তার একটা স্মরণীয় চিঠি ছিল বংশাল রোডের হোটেলের খাওয়া নিয়ে। তিনি তখন লিখেছিলেন, বংশাল রোডের হোটেলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে বড় বড় রুইমাছের টুকরো দেখলে তার জিহ্বে পানি এসে যেতো, কিন্তু অর্থাভাবে খেতে পারতেন না। আর্থিক অবস্থার কারণে ছোট্ট থাকতে, এমনকি বড় হলেও অনেকের অনেক খাবার কপালে জোটে না। দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। খাওয়ার বিষয়ে আমার এখন আর অতৃপ্তি নেই। মনে চেয়েছে, কিন্তু খাইনি, এমন খাবার আমার মনে পড়ে না। হ্যাঁ, ছোট্ট থাকতে আমরা অনেক দামী ফল খেতে পাইনি। কোনো কোনো কেনা ফল কম খেয়েছি। গ্রামে হয় এমন ফলের যেমন, আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, তরমুজ, বাঙ্গি বা ফুটি, জামরুল, জাম, কলা, এসবের তো কোনো অভাব ছিল না। আম এবং কাঁঠালতো পঁচেই যেতো অনেক সময়। তখনতো কারো গাছতলায় আম, বরই অন্যেরা নিয়ে গেলেও কেউ কিছু বলতো না। পুকুর পাড়, বড় জঙ্গলের গাছের ফল-ফলাদি বেশিরভাগ নিচে পড়েই থাকতো। তখন, আমাদের ছোটবেলায়, সেই পঞ্চাশের দশকে, এমনকি ষাটের দশকের প্রথম দিকেও, আমাদের এলাকায় এসব ফলের অভাব ছিল না। মানুষ ছিল কম, গাছ-গাছালি ছিল বেশি। আহারে দিন, এখনতো কারো গাছতলায় গিয়ে ফল পেয়ে এনে খেয়ে ফেলবে তা ভাবাই যায় না! আমার কোনো খাবার না খাওয়ায় অতৃপ্তি না থাকার মূল কারণ হলো আমার মায়ের একটা উপদেশ। মা তখনকার আমলের অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলের মেয়ে, রক্ষণশীল পরিবারের, তা-ও আবার ধার্মিক পরিমন্ডলের। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত নাকি পড়েছিলেন। মার কাছ থেকেই শুনেছিলাম। মেয়েলি হাতে চিঠি লিখতে পারতেন। আব্বার কাছে বাহক মারফত চট্টগ্রামে চিঠি পাঠাতেন। মা বলেছিলেন, কোনো কিছু খেতে ইচ্ছে হলে প্রথম সুযোগেই খেয়ে ফেলবি। পরে আর সেটা খেতে ইচ্ছে না-ও হতে পারে, কিংবা পাওয়া না-ও যেতে পারে। মায়ের এই উপদেশ আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। সামর্থ্য যখন কম ছিল তখনো কম করে হলেও খেয়েছি। এখন আমার মনে হয়, আমি জীবনে যত বেশি খেয়েছি তজ্জন্যই আল্লাহ আমাকে শাস্তি দিতে পারেন। আমি এতো এতো খাবার কেন খেলাম! আমার জবাব থাকবে, ইয়া আল্লাহ, রিজিকের মালিক তুমি, তুমিই খাইয়েছ, আমি শোকর করি।

আইয়ুব খান ভাই পরে মাটির বড় ঠিকাদার হয়েছিলেন। প্রচুর টাকারও মালিক হয়েছিলেন। ঢাকাইয়া মেয়ে বিয়ে করে জিন্দাবাহার দ্বিতীয় লেনে বাড়িও করেছেন। তিন ছেলে, দুই মেয়েকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আজ মনে পড়ে, আইয়ুব খান ভাই কত আপনজন ছিলেন। একদিন, সম্ভবতঃ ১৯৭২ সাল হবে, বন্ধুবর হাফিজ, খন্দকার হাফিজুল হককে নিয়ে তার বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। দীর্ঘদিন জটিল রোগে অসুস্থ থেকে ১০/৬/২০২০ তারিখে হাফিজ মারা গেল। বাদ জোহর তার জানাজায় ডিস্টিলারি রোডে যোগ দিলাম। এ হাফিজকে ১০০ টাকায় বিয়ে করিয়ে ১৫ নভেম্বর, ১৯৭৬ সালে সেই যে ডিস্টিলারি রোডে তার শ্বশুবাড়িতে রেখে এলাম, সেই বাড়িতেই তার মৃত্যু হলো। বড় অমায়িক ছিল হাফিজ। ভালো গান গাইত। বুলবুল ললিতকলা একাডেমির ছাত্র ছিল। বাড়ি আমাদের ছাগলনাইয়াতে। ১৯৭২ সালে পরিচয়, তখন সে ঢাকা কলেজ পড়ে। সার্কুলার রোডে (ভূতের গলি) এক বাসায় সে লজিং থাকে। নবাব আশকার আলি জুটমিলের এক বড় কর্তা রুহুল আমিনের বাসায়। তার দুই ছেল রুমী-জামি এবং এক মেয়ে নীনাকে পড়াতো। আমি থাকতাম ১৫ সার্কুলার রোডে লজিংয়ে। এসএম হলে সিট থাকলেও সবসময় থাকতাম না। আমার ছিল এক ছাত্র জহির উদ্দিন ওরফে বাবু। বাবুর মায়ের শেষ বয়সের একমাত্র সন্তান। পরশুরাম গুতুমা চৌধুরী বাড়ির অথবা বাসপদুয়া চৌধুরী বাড়ির মেয়ে। দীর্ঘদিন সন্তান না হওয়ায় বাবুর আব্বা আরেক বিয়ে করে কমলাপুরের দিকে আলাদা থাকতেন। সুন্দর মানুষটাকে একবার মাত্র দেখেছিলাম। একতলা এ বাড়িতে বাবুর মা, তখনো বুড়িই বলা চলে, একাই থাকতেন। বাবুকে ল্যাবরেটরি স্কুলে আনা-নেয়ার এবং বাসার কর্মে সহায়তার জন্য একটা ছেলে ছিল। আর আমি। একই প্লটের দক্ষিণাংশে একটা টিনসেডে তাদের আরেক চৌধুরী সাহেবের রেশন দোকান ছিল। সার্কুলার রোডের একটু দক্ষিণ পাশেই সেন্ট্রাল রোডে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পিতা হালিম চৌধুরীর বাড়ি। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে একদিন সর্বশেষ মুনীর চৌধুরী স্যারকে একটা গোলগাল কদু (আমরা স্থানীয়ভাবে বৈরাগ্যা কদু বলতাম) হাতে গাড়ি থেকে নামতে দেখেছিলাম। স্যারকে এই-ই আমার শেষ দেখা।

রুহুল আমিন সাহেবের স্ত্রীকেও পরে আমি ইংরেজি পড়াতাম। নারায়ণগঞ্জের কি মর্গান স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। বিয়ে হয়ে যাওয়াতে তিনি এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারেননি। এখন দিতে আগ্রহী। কিন্তু শেষতক আর তার পরীক্ষা দেয়া হয়েছে কি না জানি না। হাফিজ ওখান থেকে চলে আসার পর এবং আমারও ’৭৪-এ লজিং ছেড়ে দেয়ার পর আর যোগাযোগ হয়নি। জীবনে চলার পথে কত কত আপনজন যে পরে হারিয়ে যায়Ñ তাই বাস্তবতা। রুহুল আমিন সাহেব ইন্দিরা রোডের পশ্চিম পাশের এলাকায় বাড়ি করেছেন শুনেছি, কিন্তু যাওয়া হয়নি। রুহুল আমিন সাহেব যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন ওই বাড়িটা আমার শাশুড়ীর উকিলবাপ আজিজ নানার বাড়ি। তিনি খাদ্য অধিদপ্তরে চাকরি করতেন। তার বড় ছেলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বশির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য বিভাগে আমার ক্লাসমেট। তার অপর ছেলে বিগ্রেডিয়ার তৌহিদ ছিল আমার স্ত্রীর মামা হলেও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এ তৌহিদ মামা চট্টগ্রামে পোস্টিংয়ে থাকতে আমরা ১৯৮৩ সালে চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিলাম।  [ চলবে ]

(সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ১৬ আগস্ট ২০২১ প্রকাশিত)