মঙ্গলবার, ০৩-অক্টোবর ২০২৩, ০৫:২৮ অপরাহ্ন

রাষ্ট্র: সংবিধান ও মানবাধিকার 

shershanews24.com

প্রকাশ : ২৬ আগস্ট, ২০২১ ০৮:৫৪ অপরাহ্ন

এ্যাডঃ তৈমূর আলম খন্দকার: “মানবাধিকার” “মানবাধিকার” বলে দেশ ও জাতি গলাফাটিয়ে চিৎকার করছে, গড়ে উঠেছে অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন, এছাড়াও রয়েছে অসংখ্য বিদেশী মানবাধিকার মূখপাত্র। যে সকল ক্ষমতাশালী রাষ্ট্র বিশেষ করে আমেরিকা, ভারত পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসহ ছোট ছোট রাষ্ট্রের মানবাধিকার হরণ করছে তারাও “মানবাধিকার” “মানবাধিকার” গেল বলতে বলতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, প্রচারের জন্য খরচ করে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। আফগানিস্তানকে মার্কিনীরা দখল করে সেখানেও মার্কিনী মানবাধিকার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘ কর্তৃক মানবাধিকার সনদ একটি উপহাসের পাত্র মাত্র। কারণ, পৃথিবীর কোথাও এর কার্যকারিতা নাই। রোহিঙ্গারা মানুষ নয় বরং কীট পতঙ্গের মত দিন যাপন করছে, কিন্তু “বিশ্ব মানবাধিকার” তাদের জন্য অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এমনি বহু ঘটনা ঘটছে যা পৃথিবীবাসী জানে, আবার কোনোটা অজানাও থেকে যায়। অমানবিক ঘটনার মাধ্যমেই পৃথিবীর সেরা সেরা বহু ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। একজন খুন করলে খুনির ফাঁসি হয়, ১০০০ খুন করলে ইতিহাসের পাতায় খুনি হয় “হিরো”। ইতিহাস সে হিরোকে যারপরনাই সম্মান দেয়। ইতিহাসবিদের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে নায়ক ও খলনায়কের অবস্থান। ফলে অনেক সময় নায়ক পরিচিতি লাভ করে খলনায়ক হিসাবে, খলনায়কের পরিচিতি আসে নায়ক হিসাবে এবং এটাই পৃথিবীর ইতিহাসের ট্রাজেডি। 

সরকার বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন গঠন করেছে সত্য, কিন্তু মানবাধিকার বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন আইন পাশ করে নাই। তবে সংবিধানের প্রস্তাবনার তৃতীয় অনুচ্ছেদে “মৌলিক মানবাধিকারের” কথা উল্লেখ রয়েছে। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা আছে যে, “প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।” উল্লেখ্য, সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধন) আইন ’ ১৯৯১ (১৯৯১ সনের ২৮নং আইন) এর ২ ধারা বলে সংবিধানে “প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।” প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় যে, শেখ হাসিনা সরকার আমলে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে জনগণের অংশ গ্রহণ কতটুকু নিশ্চিত হচ্ছে তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভালো করেই জানেন (!)। বাস্তব চিত্র যাহাই হউক না কেন নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, প্রশাসন, মন্ত্রী ও বুদ্ধিজীবীদের মুখে মুখে তো জনগণের অংশ গ্রহণেই নির্বাচন হচ্ছে (!) সদ্য বিদায়ী সেনা প্রধান জেনারেল আজিজ পূর্বাচলে “জলসিড়ি” নামক একটি প্রতিষ্ঠান উদ্বোধন প্রধান অতিথির ভাষণে এমনটাই বলেছিলেন যে, ইতোপূর্বে এতো সুন্দর নির্বাচন আর হয় নাই। সেনা প্রধানের বক্তব্য খÐনের ধৃষ্টতা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোন জনগণের থাকার কথা নয়, ফলে বদ হজম হলেও তা হজম করাই নিজ ও পরিবারের নিরাপত্তার জন্য শ্রেয়। 

স্বাধীন বাংলাদেশে ৫০ বৎসরেও মানবাধিকার প্রয়োগ সংক্রান্ত কোন আইন পাশ হয় নাই। সংবিধানের তৃতীয় ভাগ মৌলিক অধিকার চ্যাপ্টারের অনুচ্ছেদ-২৬ থেকে ৪৪ পর্যন্ত মানবাধিকার রিলেটেট অনেকগুলো অনুচ্ছেদ থাকলেও বাস্তবায়নের অভাবে সংবিধানটি মুখ থুবড়ে পড়েছে এবং জনগণ এটাই দৃঢ় চিত্তে বিশ্বাস করে, যদিও সরকার একথা মানে না, কারণ ক্ষমতায় থাকলে চাটুকার বেষ্টিত সরকারের নিকট নিজের ভুল ধরা পড়ে না। তাছাড়া “সংবিধানের নীতিমালা” ও “ক্ষমতার প্রয়োগ” যদি সাংঘর্ষিক হয় তখন জনগণের মৌলিক অধিকার ও মানবতাকে বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতাকে আকড়ে রাখার সকল অবৈধ/বৈধ পন্থা অবলম্বনই সরকারের নিকট মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়।    

সরকার বা পার্লামেন্ট সদস্যদের উপস্থাপিত প্রস্তাবনার উপর আলোচনা পর্যালোচনা করে পার্লামেন্ট আইন প্রনয়ণ করে যা রাষ্ট্রপতির সম্মতি স্বাক্ষরে অনুমোদিত হয়। রাষ্ট্রপতি পুনঃ বিবেচনার জন্য প্রস্তাবিত আইন ফেরৎ না পাঠালে তাহাই অনুমোদিত হিসাবে গণ্য হয়ে থাকে। আমাদের রাষ্ট্রে মানবাধিকারকে প্রাধান্য দিয়ে কোন আইন গৃহিত বা পাশ হয় নাই। রাষ্ট্রের আইনপ্রনয়ণ নির্ভর করে ক্ষমতাবান রাষ্ট্রপতি বা ক্ষমতাবান প্রধানমন্ত্রীর উপরে। তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছায়ই আইন। আইনের খসড়া প্রস্তুত করে আমলারা। আইনের খসড়া নিয়ে বির্তক হওয়াতো দূরের কথা সংসদ নেতার প্রস্তাবিত কোন আইন পাশ হচ্ছে তাহাও কোনো এমপি খুটিয়ে দেখার সুযোগ নাই। এক সময় বিচারপতির নজরুল ইসলাম চৌধুরী এমনটাই বলেছিলেন যে, কেরানিরা (আমলা) আইন লিখে যা পার্লামেন্টে “হা” “হা” করে সব পাশ করে দেয়। আইন নিয়ে ডিবেট করার যোগ্যতা সম্পন্ন সংসদ সদস্যের অভাব রয়েছে। সম্প্রতিকালে পার্লামেন্টে ব্যবসায়ী প্রাধান্য বেশী পাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোও খুঁজে খুঁজে ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের দলে ভিড়াচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর নিকট টাকা ওয়ালাদের অনেক গুরুত্ব রয়েছে। কারণ বাংলাদেশের নির্বাচন এখন টাকার খেলা। রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটি টাউট শ্রেণী রয়েছে যারা টাকার বিনিময়ে নির্বাচনী খেলা খেলে। নীতি-আদর্শ বলতে কোনো কিছুরই ধার ধারে না। নির্বাচন প্রাক্কালে কোরবানি গরুর হাটের মত সব হাটেই ডু মারে, কোন না কোন হাটে উচ্চ মূল্যতো পাওয়া যাবেই, এ প্রত্যাশায়। 

অনুরূপ অবস্থা চলছে পার্শবর্তী রাষ্ট্র ভারতেও। ১৫/৮/২০২১ ইং তারিখে সুপ্রিম কোর্টে আয়োজিত ভারতের স্বাধীনতা দিবসের এক অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি এনভি রামানা আক্ষেপ করে বলেন, “আইনের কোনো স্পষ্টতা নেই। আমরা জানি না কী উদ্দেশ্যে আইন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জনগণ। এটা হচ্ছে, যখন পার্লামেন্টে আইনজীবী এবং বুদ্ধিজীবী উপস্থিত নেই। তিনি আরো বলেন, যদি আমাদের স্বাধীনতা যোদ্ধাদের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো, তাদের অনেকেই ছিলেন আইনগত দিক দিয়ে জানাশোনা। লোকসভা এবং রাজ্যসভার প্রথম সদস্যপদে বসানো হয়েছিল আইনজীবী সম্প্রদায় থেকে।” তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “এখন আমরা পার্লামেন্ট হাউজে যা দেখি, তা দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু ওই সময় পার্লামেন্টে বিতর্ক হতো অত্যন্ত গঠনমূলক। আর্থিক বিল নিয়ে বিতর্ক আমি দেখেছি। এই বিতর্ক থেকে অনেক গঠনমূলক পয়েন্ট বেরিয়ে আসত। আইন নিয়ে আলোচনা হতো এবং তা অনুমোদন করা হতো” (জাতীয় পত্রিকা, তাং-১৬/৮/২০২১)। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। রাজনীতিবিদ ও পার্লামেন্ট সদস্য জন্মদেয় রাজনৈতিক দল। হালে রাজনৈতিক দলে টাকা ওয়ালাদের অনেক প্রভাব এবং দলগুলোও টাকা ওয়ালাদের টাকা কোন পন্থায় উপার্জিত তা দেখে না, লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে দলে ভিড়িয়ে নমিনেশন দেওয়ার জন্য, যেমনি লোলুপ দৃষ্টিতে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি একশ্রেণীর মানুষ তাকিয়ে তাকে কামনা বাসনার মানসিকতায়। জনগণ ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ তখন গৌন হয়ে যায়, কোন পন্থায় ক্ষমতায় বসা যাবে এটাই হয়ে যায় মূখ্য। ফলে আমাদের দেশের রাজনীতি মেধাশূন্য হয়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতি পুলিশ, আমলা ও গোয়েন্দাদের হাতে বন্দী হয়ে পড়েছে।   

প্রায়সই অভিযোগ উঠে যে, গ্রেফতার করার পর পুলিশ গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির সহিত আইনজীবী ও আত্মীয় স্বজনদের সাথে সাক্ষাৎ করতে দেয় না। এমনও সংবাদ পাওয়া যায় যে, আটক করার বেশ কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ায় আনুষ্ঠানিক গ্রেফতার না দেখিয়ে পুলিশ কাষ্টডিতে ফেলে রেখে নির্যাতন করে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গুম, খুনতো এখন প্রায় গা সওয়া হয়ে গেছে। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির সাথে কি রকম আচরণ করতে হবে, এ মর্মে সংবিধানের ৩৩(১) ও ৩৩(২) অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “(১) গ্রেপ্তারকৃত কোন ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাঁহার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না। 
(২) গ্রেপ্তারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে গ্রেপ্তারের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে (গ্রেপ্তারের স্থান হইতে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আনয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ব্যতিরেকে) হাজির করা হইবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাঁহাকে তদতিরিক্তকাল প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না।”

সংবিধান ও শাসন ব্যবস্থা যদি সাংঘর্ষিক হয় এবং সংবিধান যখন কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে তখনই আইনের প্রতি গণমানুষ আস্থাহীন হয়ে পড়ে। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে একটি জাতি কেন স্বাধীনতা চায়? এর পিছনের কারণ কি? এর পিছনের যুক্তি হলো মানুষ চায় তার বাক স্বাধীনতা, মুক্ত চিন্তার স্বাধীনতা জন্মগত ও মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা সহ রাষ্ট্র থেকে মানবিক আচরণ। যে ক্ষমতায় থাকে সে যদি সীমালঙ্ঘন করে, এ সীমালঙ্ঘনের দায় রাষ্ট্রকেই বহন করার কথা, কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় যে, রাষ্ট্র সীমালঙ্ঘনকারীকেই নিরাপত্তা দিয়ে থাকে এবং তখনই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। মানবাধিকার বাস্তবায়নে যদি সুনির্দিষ্ট কোন আইন থাকতো তবে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী বা সীমালঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার একটি রাস্তা খোলা থাকতো। সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, “কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রনা দেওয়া যাইবে না, কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্চনাকর দÐ দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।” সংবিধানের এই অনুচ্ছেদে প্রদত্ত নির্দেশনায় কি কার্যকারিতা বর্তমানে রয়েছে? 

লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (এ্যাপিলেট ডিভিশন), E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com