
shershanews24.com
প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১১:২০ পূর্বাহ্নসাপ্তাহিক শীর্ষকাগজের সৌজন্যে, গত সংখ্যার পর: চট্টগ্রাম থেকেই এ মামা আমার স্ত্রীর ড্রেসিং টেবিল বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন। আমরা দাম পরিশোধ করেছি। তৌহিদ মামার বিয়ের আগ পর্যন্ত তার এ ভাগনির সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এখন তারা মিরপুর সেনানিবাসে বাড়ি করেছেন। নানি মারা যাওয়ার পর আমরা সেখানে প্রথম গেলাম। ভূতের গলি, অর্থাৎ সার্কুলার রোডের বাড়িতে নানিকে আমি তার মৃত্যুর মাস আটেক পূর্বে গিয়ে দেখে এসেছিলাম। এক প্রতিবেশীর দুমেয়ে বুলবুলি ও বেলিকে হাফিজের জানালা খুললেই দেখা যেতো। আমরা দু’জন দু’জনকে ভাগ করে নিয়েছিলাম। বুলবুলি তার, বেলী আমার। আমরা তাদের পাখি ও ফুল নামে নিজেদের মধ্যে সংকেত ব্যবহার করতাম। জীবনে কোনোদিনও আমাদের হাফিজের ‘পাখির’ সাথে আর আমার ‘ফুলের’ সাথে ওখানে থাকাকালীন একবারও কথা হয়নি। অথচ জানালা খুলে দেখলেই আমি বলতাম তোর পাখি এসেছে। সে বলতো তোর ফুল এসেছে। হাফিজের সাথে গানের বদৌলতে অনেক মেয়ের ভালো সম্পর্ক ছিল। হাফিজের হাসি-হাসি মুখ, সুন্দর মোলায়েম কথা মেয়ে-পটানো ছিল। কিন্তু ছেলেটি বড় ভালো ছিল। তার ডিগ্রির ফরম পূরণের সময়ে আমি মাটির ব্যাংক ভেঙে সব টাকা তাকে দিয়ে দিয়েছি। শ্বশুরবাড়িতে একটা ফ্ল্যাট ওরা নিজেরা করে নিল। ১৯৯৪ সাল, আমি তখন যমুনা বহুমুখী সেতু কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত পরিচালক। একদিন হাফিজের বাসায় গেলাম। বাথরুম মাত্র একটা। একজন ভেতরে ছিল, আমি বেকায়দায় পড়লাম। ড্রইংরুমের পাশে আরেকটা বাথরুম করতে বললাম। ও টাকা চল্লিশ হাজার দিতে বলল। রাজি হলাম। শর্ত প্রতিমাসে পাঁচশত টাকা করে ৮০ মাস আমার ব্যাংক হিসাবে (অগ্রণী রমনা শাখায়) জমা দেবে। সে টাকা সে শোধ করেছে বটে, তবে মাঝে মাঝে অনেক ডিফল্টার হয়ে। যত মেয়ের সাথে হাফিজের ভালো সম্পর্কই থাকুক না কেন, সে মাসুমার কাছে আটকা পড়ে গেল। দু’জনে একই ডিপার্টমেন্টে, শ্রম অধিদপ্তরে চাকরি করে পরে বিয়েতে আবদ্ধ হলো। ভূতের গলি লজিংয়ে থাকতেই একদিন হাফিজের পাঞ্জাবিতে বুক বরাবর লিপস্টিক লেগে থাকতে দেখে আমি কারণ জিজ্ঞেস করলে সে থতমত খেয়ে বলল, মেয়েটা চুমো দিতে গিয়ে কখন যে পাঞ্জাবিতেও লাগিয়ে ফেললো টেরই পাইনি। মেয়েটি এবং আরো কয়েকজন তাকে শার্ট-পাঞ্জাবি গিফটও করেছে। ওই যে বললাম একশ টাকায় বিয়ে করিয়ে এলাম তা হচ্ছে এমনইÑ কুড়ি টাকা সের দরে (১৯৭৬) তিন সের ভালো মিষ্টি কিনলাম, কুড়ি টাকার পান-সুপারি কিনলাম, সরকারি মটর ওয়ার্কশপের ম্যানেজার ক্যাপ্টেন (অব.) নজরুল ইসলামের গাড়ি নিয়ে বরযাত্রা হলো বিধায় তার গাড়ির পেট্রোল এগার টাকার, এক প্যাকেট গোল্ড ফ্ল্যাক সিগারেট পাঁচ টাকা আর এক টাকার পান খাওয়া। মোট ব্যয় ৯৭ টাকা। ৩ টাকা আমার লাভ।
বিয়ের পর মাসুমাকে পাঞ্জাবির লিপস্টিকের এবং কুলপাখির গল্প করলে মাসুমা অমায়িক হাসি দিয়ে বলত, বেচারা আমার কাছে ধরা খেল। হাফিজ হাসত। অসুস্থকালীন মাসুমা হাফিজের যে সেবা করেছে তাতেই মাসুমা বেহেশত পেয়ে যাবে মর্মে আমার বিশ্বাস। হাফিজের সুস্থতা কামনায় মাসুমা প্রত্যেকদিন রোজা রাখত। হাফিজও মাসুমা ছাড়া কিছু বুঝত না। ছেলে দুটিও (তমাল-তুষার) বেশ চমৎকার। তমালের স্ত্রীকে দেখেও আমি মুগ্ধ হলাম। আমার ধানমন্ডি ৩নং রোডের সরকারি বাসায় থাকালীনও হাফিজ-মাসুমা এসেছে, বেড়িয়েছে, থেকেছেও। কিন্তু ২০০৭ সালে আমি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসরে এসে মিরপুরের রূপনগরের বাড়ি চলে এলে তাদের আর এ বাড়িতে আসা হলো না। আজ আসি, কাল আসি করতে করতে হাফিজ চলেই গেল। তার লিভার এবং কিডনিতে বড় সমস্যা হয়েছিল। গুরুতর অসুস্থ থাকাকালীন আসগর হাসপাতালে দেখতে গেলে তার বড় ছেলে তমাল সাথে না থাকলে তাকে আমি চিনতামই নাÑ এমন অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। পরে স্ত্রীসহ আবার তার বাসায় গিয়ে দেখে আসি। সে-ই শেষ দেখা। তখন সে একটু উঠতে পারতো, নিজে নিজে মুখও ধুয়েছে, আমরা একসাথে অনেকক্ষণ থেকেছি, কথা বলেছি। এরপর করোনা, টেলিফোনে খোঁজ নেয়া। খারাপ হয়, ভালো হয়Ñ এমন অবস্থায় চলছিল। নিচতলার এককক্ষে তারা দু’জন নেমে এসেছিল ওর জন্য। হঠাৎ করে সে চলে গেল। আজ মনে পড়ে, ডিগ্রি পরীক্ষার তার অ্যাকাউন্টেন্সিতে খারাপ হয়েছে বলে সে দ্বিতীয় বিভাগ পাওয়া নিয়ে সন্দিহান ছিল। আমাদের স্কুলের ছাত্র নূরুজ্জামান (সেও মৃত) ঢাকা কলেজে চাকরি করত। বড় করিৎকর্মা ছিল। ওকে বললে সে হেড এক্সামিনারকে দিয়ে হাফিজকে নম্বর বাড়িয়ে দ্বিতীয় বিভাগ নিশ্চিত করেছিল। হাফিজ চলে গেল, একটা সম্পর্কের ইতিহাস শেষ হলো, এবার কে যাব? বিয়েতে যাওয়া সিরাজ, ইস্কান্দারকে টেলিফোনে জানালাম। ফেনীতে বিসমিল্লাহ হোটেলের মালিক রফিক সাহেবকে, দাগনভূঞার চরমজলিসপুরের বাড়িতে অবস্থানরত আবদুল ওহাব খোকনকে, বাড্ডায় থাকা খোকনের ভাই মোহনকে জানালাম। করোনাকাল। সিরাজ চট্টগ্রামে, আসাতো সম্ভব নয়। ফেনীর ওদেরও আসা অসম্ভব। মোহন এবং ইস্কান্দার ঢাকায়, দোয়া করবে বলে টেলিফোন রাখল।
আমি বড় একা হলাম যেন। আমি আর করোনা ভয়েও ঘরে থাকতে পারলাম না। এমনিতেই পাছে লোকে কিছু বলে, এই ভয়ে ১ মে দুটো জানাজায় যাইনি। যতটুকু না আমার নিজের সুরক্ষার ভয়, তারচেয়ে অনেক বেশি যেখানে যাব তাদের ভয়মুক্ত রাখা। আমার আপন ছোট ফুপু এবং ছোট ভাইয়ের শ্বশুর ১লা মে, ২০২০ ফেনীতে মারা গেলেন। ঢাকা থেকে জানাজায় যেতে পারতাম। মৃত্যু সংবাদ শুনলেইতো আমি ফেনী চলে যাই, ঢাকাতেও সব জানাজায় হাজির হই। কিন্তু করোনাকালে কেউ উৎসাহিত করল না। ছোট ভাইয়ের ছেলে শাহনেওয়াজ (সমীর) বাড়ি গেলে চৌকিদার এসেছিল, থানা থেকে কারা যেন পুলিশও আনিয়েছিল; মাঝি বাড়ির হাবু ভাইছার নাতি হাসপাতাল থেকে ডেলিভারি হওয়া বোনকে নিয়ে বাড়ি গেলে তাদেরও পুলিশি জেরায় পড়তে হয়েছিল। পরে তাদের ১৪ দিন করে ঘরেও থাকতে হয়েছিল। সমীর যাচ্ছে শুনে তার ছোট বোন টুম্পা ওর বাচ্চাসহ শ্বশুরবাড়ি চলে গেল। সমীর বাড়ি থেকে ঢাকা না ফেরা পর্যন্ত টুম্পা আর আমাদের বাড়ি আসেনি। অধিকন্তু, পথে আবার পুলিশের কোনো ঝামেলা হয়। সব ভেবে আমার দুই আপনজনের জানাজায় আমি শরিক হতে পারিনি। এই-ই হলো করোনার বাস্তবতা। বড় ভাই আলেম, ছোট ফুপুর বড় ছেলেও আলেম। বড় ভাই বললেন, জানাজার নামাজ ফরজে কেফায়া, মহল্লাবাসীর পক্ষে কেউ কেউ আদায় করলেই চলবে। আমিও জানতাম। তাও আমার ছোট ফুপুযে! ছোট থাকতে কোলে নিয়েছেন। কত আদর করেছেন। সর্বশেষ গত বছর তাকে দেখে এসেছিলাম। ’৯০-এর উপর বয়স হলেও ভালোই ছিলেন। মৃত্যুর দিন সকালেই বড় ভাইয়ের ছেলে আলাউদ্দিনের মাধ্যমে তার ঈদের টাকা পাঠিয়েছিলাম। ভাগনি রহিমাও দু’হাজার টাকা দিয়েছিল। ঈদের টাকা দেয়ার আমার একজন চলে গেলেন। পিতৃক‚লে আব্বার মামাতো ভাইরা ছাড়া (গত বছর দেখে এসেছিলামÑ এসপি জসিমদের বাড়ি, জাহানপুর মোল্লাবাড়ি) আব্বার সমসাময়িক আর কেউ নেই, মাতৃক‚লে মায়ের, ভাই সম্পর্কের কেউতো রইল না। মেঝো ফুপুর মৃত্যুতে গিয়েছিলাম, সম্ভবত ৪র্থ শ্রেণির বছর। তার মৃত্যুর পর বছর দাদা মারা গেলেন, ১৯৬১ সাল।
যা বলছিলাম, হাফিজসহ আইয়ুব খান ভাইয়ের ১০ জিন্দাবাজার ২য় লেনের বাড়িতে গেলাম। তার বাড়ির ঠিক বিপরীতেই নয়াবাজার মসজিদ। সেই ১৯৭২ সাল। আমাদের দু’জনকে আপ্যায়ন করা হলো। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়ে ভাই পাশাপাশি নামলেন, উপরের দিকে অর্থাৎ পেছনে দেখলেন। ভাবী ঘরে ঢুকে গেলেন। চট করে দশ টাকার একটা নোট আমার হাতে গুঁজে দিলেন। আমি কিছু বলতে চাইলে, চুপ বলে থামিয়ে দিলেন। বুঝলাম, ভাবীর সামনে দিতে সাহস করেননি হয়তো। স্ত্রীর সামনে আমিও অনেক সময়ে কাউকে টাকা দিতে চাইতাম না। দিতামও না। এমন কত ঘটেছে। যদিও ভাবীকে আমি দিলখোলা দেখেছিলাম। ঢাকাইয়া ভাবী, আমার থেকেও কালো। ঢাকাইয়া কথা বলেন। একদিন পাশাপাশি বসে বলেছিলাম, ভাবী, আপনি দেখি আমার থেকেও কাল। ভাবী হেসে ফেললেন। তাজ্জব হলাম, একটুও রাগ হলেন না। বললেন, ভাই, যত কাল, তত ভালো। আপনার ভাই মেহেরবানী করে বিয়ে না করলে বোধহয় আমার বিয়েই হতো না। বললাম, ভাবী, আপনি কালো মানিক, মালদার পার্টি, ভাই বিয়ে না করলেও ‘আবে হালা’ গোছের একজন এসে যেতো। ভাই পাশে বসা, হাসলেন। তাদের দু’জনের এত মিলমিশ ছিল যে, ভাইয়ের মৃত্যুর পূর্বে আমি আম নিয়ে গেলাম। ভাই তখন তিনতলায় একা থাকেন। ছোট্ট জায়গায় তিনতলা পর্যন্ত করা। নিচতলায় দোকান। ভাবীর হাতে আমের পোটলা দিতেই ভাবী হেসে বললেন, এত বড় বড় আম, অর্ডার দিয়ে গাছে ধরিয়েছেন নাকি ভাই? তিনি পোটলা আমার হাতে দিয়ে দিলেন। তিন তলায় আপনার ভাইয়ের হাতে আগে দিন। তিনি পছন্দ করে যে ক’টা রাখেন রাখবেন, তারপর বাকিগুলো নিচে পাঠাবেন। আমি বললাম, এটা কেন, আপনি কেটে পাঠাইলেইতো আমরা তিনতলায় একসাথে খেতে পারব। ভাবী আবেগভরা উত্তর দিলেন, ভাইরে, আপনি ভাইয়ের জন্য আম নিয়ে এসেছেন, আপনার ভাই দেখে যে আনন্দ পাবেন সেটাইতো বড় আনন্দ। ভাই বড় একটা আম বেছে নিয়ে আমাদের কেটে দিতে পাঠালেন। তার কক্ষে কত রকমের ফল মজুদ দেখলাম।
স্মৃতিতে ভেসে এলো, এক সময়ের আইয়ুব খান ভাই বংশাল রোডে হোটেলে রুই মাছের বড় টুকরো দেখে টাকার অভাবে খেতে পারেননি বলে চিঠি লিখেছিলেন। একদিন তার পেট ধরে বললাম, আইয়ুব ভাইছা, আপনার বেঁটে শরীরে এত বড় পেট বড় বেমানন। তার জবাব, এখান থকে রমনা পার্কে হাঁটতে যাই, হেঁটে আসি, পেটতো কমে না। কারণ আছে বদিউর, এ পেট অভাবে খেতে না পেয়ে পিঠে লেগেছিল। এখন আল্লাহ এ পেটের খাবারের অফুরন্ত নিশ্চয়তা দিয়েছেন, অতএব পেট খুশিতে বড় হচ্ছে। মনে পড়ে, ওই দশ টাকা তখন কত বড় টাকা। আমি আর হাফিজ আলাউদ্দিন রোডে হাজীর বিরিয়ানি খেলাম পেটপুরে। তা-ও বোধ হয় আড়াই টাকার বেশি খরচ হয়নি। আমি টিউশনি করে, বৃত্তির টাকাসহ বেশ টাকা খরচ করতাম। সেই ১৯৭০ সালেই আমি একশ’ টাকায় এক ছাত্র পড়াতাম। স্বাধীনের পরতো তা ২৫০ টাকায় পৌঁছেছে। ৭৬, সেগুনবাগিচায় চিওড়া কাজী বাড়ির কাজী গোফরানের বাংলাদেশ ট্যাক্স ডিসিশন্স নামে অফিস ছিল, সাথে বাসা। তার ছেলে চয়নকে (তখন সে ওয়ান বা টুতে পড়ত) ১৯৭২-’৭৪ সালে ২৫০ টাকায় পড়াতাম। দশ টাকা বড় কথা নয়। ভাইয়ের যে অকৃত্রিম আন্তরিকতা দেখলাম সেটা ভোলার নয়। আমি শিখলাম। আমিও পরে এভাবে টাকা দেয়া শুরু করলাম।
১৯৭৩ সালে সেশনজটে পড়েছি আমরা। তিন বছরের অনার্স ১৯৭২-এর পরিবর্তে ১৯৭৩-এ শেষ হলো। শাহবাগে হোটেল সিলভানায় আড্ডা দেই। মালিক খায়ের সাহেবের প্রথমে পাপপু রেস্টুরেন্ট ছিল, পরে সিলভানা, তার ছোট মেয়ের নামে। একদিন দেখি আইয়ুব ভাই হোটেলে ঢুকেছেন। সাথে আরো একজন। আমাকেও খাওয়ালেন। বললেন, আমার সাথে চল। হোটেল থেকে মিষ্টি নিলেন। ট্রাকে ড্রাইভারের পাশে আমরা দু’জন বসলাম। বললেন, মাটির ঠিকাদারতো, এটা মাটি টানার ট্রাক। কাকরাইল মসজিদের পূর্ব পাশে জনস্বাস্থ্য অফিসে ঢুকলেন। ওখানকার নির্বাহী প্রকৌশলীর কক্ষে। পিয়নকে ডেকে মিষ্টির প্যাকেট দুটি দিয়ে বললেন, একটা তোমরা সবাই খাবে, আরেকটা যাওয়ার সময়ে স্যারের গাড়িতে উঠিয়ে দেবে। পিয়নকে ১০০ টাকার একটা নোটও হাতে দিলেন দেখলাম। নির্বাহী প্রকৌশলীর সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, আমার মামাতো ভাই, স্যার। দেখা হলো, সাথে নিয়ে এলাম। স্যার আমাদের চা খাওয়ালেন। একটু পরে ভাই আমাকে বললেন, তুমি একটু বাইরে যাও, আমি আসছি। আমি বেরিয়ে এলাম। ভাই পরে আসলেন। পরে বললেন, তোমার সামনে তো আর স্যারকে টাকা দেয়া যায় না। ঠিকাদার হলে এভাবে বখরা দিতে হয়, নাহলে কাজ পাওয়া যাবে না, করাও যাবে না, কী বুঝলা? পরে নিজের চাকরিতে এসে ঘুষ না খেলেও আমি বুঝেছিলাম। সরকারি চাকুরিতে আমার অনুভূতি সিরিজের ৫নং বই ‘কিছু প্রিয় কিছু অপ্রিয়’তে ঘুষের চ্যাপ্টারে অনুভূতি প্রকাশ করেছিলাম। ভাই আমাকে বললেন, কালও এ সময়ে শাহবাগ মোড়ে থেকো, আমার সাথে ট্রাকে সাইটে যাবে, ভাইকে সঙ্গ দেবে। বেকার মানুষ, থাকলাম। তার সঙ্গে ট্রাকে দু’দিন এভাবে ঘুরলাম, যেখানে মাটির কাজ পেয়েছেন, সেখানে গেলাম, কমলাপুর গেলাম, হাতিরপুলের পুল ভাঙ্গার মাটির কাজও তিনি করেছিলেন। দু’দিন পর ভাই বললেন, পরদিন থেকে তিনি কেরানীগঞ্জের ওদিকে থাকবেন, আমার আর শাহবাগ আসা লাগবে না। ট্রাক থেকে নামার সময়ে আমার হাতে ১৪০ টাকা ধরিয়ে দিলেন। আমি ইতস্তত করছিলাম। বললাম, এত খাওয়ালেন, আবার টাকা কিসের। বললেন, আমার সাথে সাথে থেকে আমাকে যে সঙ্গ দিয়েছ, আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। ১৪০ টাকা, বিনা কাজে, আমার সে কী আনন্দ। এ আনন্দ ভোলার নয়।
আপনজন বলতে ঢাকাতে আর তেমন আছেইবা কে। বিয়ের পর আইয়ুব খান ভাই আমাকে এবং তার ক্লাসমেট আমার ফুপাতো ভাই গোফরানকে সন্ত্রীক তার বাসায় দাওয়াত দিলেন। আমরা গেলাম। আপ্যায়নের শেষ নেই। ভাইয়ের টাকার অভাব নেই। ঢাকাইয়া ভাবী, মনও বড়। আসার সময়ে আমাদের দুস্ত্রীকে শাড়িও দিলেন। বিয়ের পর আমি বেশকিছুদিন আহাম্মক নম্বর নয় ছিলাম। কুমিল্লা ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষকতা ছেড়ে ১৪ অক্টোবর, ১৯৭৬ বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগদান করলাম। থাকবো কোথায়? অতএব ৫৭, ক্রিসেন্ট রোডে শ্বশুরবাড়ি অগত্যা মধুসূদন। আহাম্মক নম্বর নয়, বিয়ের পর যে শ্বশুরবাড়ি রয়। ৪৭৫ টাকার স্কেল, প্রথম মাসের ভাঙ্গা ক’দিনের, ১৪-৩১ অক্টোবর বেতন, বাড়িভাড়া পেলাম ৩৮৩ টাকা। নভেম্বর-ডিসেম্বর পুরো মাসের বেতন, বাড়ি ভাড়া পেলাম ৬৬০ টাকা। ১৯৭৭ সালের মার্চ থেকে ব্যাংকের সাথে বাড়ি ভাড়া চুক্তি করে ভাড়া ৪০০ টাকা হারে আর বেতনভাতা ৫১৫ টাকা, মোট ৯১৫ টাকা পাওয়া শুরু। বাড়ি ভাড়ার চেক আসত শাশুড়ির নামে, আমি তার থেকে ৪০০ টাকা নিয়ে নিতাম। কয়েক মাস পর নিজে সেন্ট্রাল রোডে সেমিপাকা ছোট্ট একটা বাসা নিলাম। বড় ছেলে স্ত্রীর পেটে, স্ত্রী চলে এলো বাবার বাড়ি। আমি গ্রিন রোডে নওয়াব আলীর গ্যারেজে বন্ধুবর ফজলুর রহমানের সাথে উঠলাম। শ্বশুরবাড়িতে থাকতে ভালো লাগে না। নিজেকে বড় বেশি ছোট মনে হয়। বাসা ছেড়ে দিলে ছোট ভাই শাহ আলমকেও আইডিয়াল কলেজ থেকে ফেনী কলেজে নিয়ে যেতে হলো।
একদিন সকালে দেখি, আমার শ্বশুর সাহেব আমার গ্যারেজের সামনে হাজির, একগোছা চাবি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আমরা সরারচর চলে যাচ্ছি। বাসায় রুবী আছে। আমার স্ত্রীÑ মূল নাম মাহফুজা আক্তার খানম, বিয়ের পর তিনি নিজে নিজে হয়ে গেলেন মাহফুজা রহমান, ডাক নাম রুবীই থেকে গেল। মেয়েরা যে বিয়ের পর কেন স্বামীর নামের লেজুড় হয় তা আমার মাথায় ধরে না। তসলিমা নাসরিনের কিছু কিছু কথা আমার মাঝে মাঝে ভালো লেগে যায়। আমি তো ভাবি, ছেলেরা স্ত্রীর নামের লেজুড় হলে অসুবিধে কোথায়? আমি যদি বিয়ের পর আমার নাম বদিউর মাহফুজা করতাম তাহলে কি উত্তম হতো না? মেয়েরা এখন এমন দাবি করতে পারেন। আমি সমর্থন দেবো। সমঅধিকারের প্রশ্ন যদি ওঠে, তাহলে দুটোই হতে পারে। বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী দুজনের নামই বদল হয়ে যাবে। স্বামী স্ত্রীর নাম যোগ করে নাম রাখবে, আর স্ত্রী স্বামীর নামের অংশ যোগ করে নাম রাখবে। ব্যস, লেটা চুকে গেল। কার নামের কোন অংশ কে নেবেন এটাতে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের স্বাধীনতা থাকবে। নচেৎ বিয়ের আগের যার যার নাম অপরিবর্তিত থাকবে। কেবল কাগজপত্র পূরণের সময় বিবাহিত নারী-পুরুষ যথারীতি স্বামী-স্ত্রীর বা স্ত্রী-স্বামীর নাম লিখবেন। এক্ষেত্রে লেডিস ফার্স্ট বিবেচনায় নিয়ে স্ত্রীর নাম আগে হতে পারে। আর একক একক কাগজ পূরণের সময়তো যিনি ফরম পূরণ করেন তিনি নাম আগে লিখেন, লিখবেন, পরে স্বামী বা স্ত্রীর নাম লেখা হবে। মাতা-পিতার নামের ক্ষেত্রেও মাতার নাম আগে চলে আসুক। বিদেশে মায়ের নামেরই প্রাধান্য থাকে। মায়ের নামের প্রাধান্যের একটা বড় যুক্তিও রয়েছে। মায়ের পরিচিতি অকাট্য। মায়ের গর্ভ থেকেই সন্তান বের হয়। পিতার পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন থাকা অস্বাভাবিক নয়। স্বামী-স্ত্রী বা স্ত্রী-স্বামীর সম্পর্ক সম্পূর্ণ বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। হালজামানায় যেভাবে ‘এদিক-সেদিক’ হচ্ছে, পরকীয়া প্রেম হচ্ছে, বিভিন্ন ঘটনা ঘটছে তাতে ‘বাবা’ কে তা প্রশ্নসাপেক্ষ হতে পারে। সামাজিক ব্যবস্থায় মানমর্যাদার কারণে অন্যথাও মেনে নিতে হয় অনেক সময়ে। এ সম্পর্কের মধ্যে অবিশ্বস্থতা থাকলে তা নিরূপণ বড় কঠিন, ডাক্তারি পরীক্ষাও তো সব সময়ে সম্ভব নয়, অনেক ফ্যাক্টর কাজ করে। বিদ্যুৎ-ওয়াসার মতো এক্ষেত্রে রিডিং দেখারও তো কোনো সুযোগ নেই। বাচ্চা জন্ম দেয়া ছাড়া বাকি ভোগবিলাসতো নানা-উপকরণে-কৌশলে পারস্পরিক সমঝোতায়-আপোষে সেরে নেয়া যায়ই। এই যে সন্তান রেখেও স্বামী ছেড়ে চলে যাওয়া, কিংবা স্ত্রী রেখে চলে যাওয়া, কিংবা বৈধ বিবাহ বিচ্ছেদে যাওয়া এবং গিয়ে পরবর্তী সম্পর্কের বৈধতা দেয়া এগুলোতো সামাজিক অবক্ষয়ের এবং ধর্মীয় অনুশাসন থেকে দূরে সরে যাওয়াই ফল বলা চলে। [ চলবে ]
(সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ৩০ আগস্ট ২০২১ প্রকাশিত)