মঙ্গলবার, ০৩-অক্টোবর ২০২৩, ০৫:১৬ অপরাহ্ন

ডোমুরুয়া থেকে সচিবালয়

shershanews24.com

প্রকাশ : ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১১:২১ পূর্বাহ্ন

সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজের সৌজন্যে, গত সংখ্যার পর: শ্বশুর সাহেব বললেন, কবীরও থাকবে। আমি চাবি রাখতে অনীহা প্রকাশ করলাম। বললাম যে, বিয়ের পরতো আমি কয়েকমাস ছিলাম। পরে বাসা নিলাম। আপনার মেয়ে একা আমার সাথে থাকতে (শারীরিক অসুবিধা, গর্ভকালীন) চাইল না। দুনিয়ার অন্যরা থাকছে না? যাদের মা-বাপের বাসা কাছে নেই তারা থাকছে না? বাসায়তো আমার ছোটভাইও ছিল। বেশি প্রয়োজন হলে কাজের সাহায্যকারী যোগাড় করতাম। তিনি কোনো কথা বললেন না। ওই পরিবারে আমার শ্বশুরই ছিলেন ভদ্রলোক। সংসারে মাতব্বরী থাকতো শাশুড়ির, যদিও তাদের দু’জনের মিলমিশ ভালো বাহ্যত। তিনি চাবি আমার সামনে চৌকিতে রেখে চলে গেলেন। আমি অগত্যা পরে গেলাম। বড় ছেলেটাও ছোট। সেমিপাকা বাড়ির দুটো ঘর। পেছনের দু’কক্ষ আলাদাভাবে ভাড়া। থাকেন আমার স্ত্রীর বিয়ের উকিল বাপ। রূপালী ব্যাংকের অফিসার। ওখানে ভাড়া থাকতেই মামা ডাকতে ডাকতে তিনি স্ত্রীর মামা হয়ে গেলেন। তার বয়সও তেমন বেশি নয়। তার বড় মেয়ে নান্নি আমার বড় ছেলে রাজিব (মাহফুজুুর রহমান) থেকে মাস দুয়েক বড় হবে। ওরা দুজন একসাথে খেলতো। বড় ঘরটার একটা তুলনামূলক বড় ড্রয়িং রুম। দুটো বেড রুম, একটা রান্নাঘর এবং একটা বাথরুম। আমার অস্বস্তি লাগছিল। আমরা বাইরে থাকলে এ ঘর ভাড়া দিলে তাদের আয় হতো। শুধু এক ছেলে থাকার জন্য এত বড় ঘরের প্রয়োজন নেই। আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হলো। দু’তিনমাস পরই উকিল বাপ আল-আমিন রোডে বড় বাসা নিলেন। পেছনের দেড় রুমের, একটা বড় রুম আরেকটা ছোট, পুনরায় ভাড়া না দিয়ে সামনের বড় ঘরটি ভাড়া দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমরা ছোট ঘরে চলে গেলাম। শ্বশুরদের জিনিসপত্র-বাড়তিগুলো বড় রুমের অর্ধেকে রেখে আমরা একখাটে ছেলেসহ এবং ছোট কক্ষ বড় শ্যালককে দেয়া হলো। বড় ঘরটা তাদের প্রতিবেশী মকবুল দারোগা ভাড়া নিলেন। তিনি নিজ বাড়ি শুরু করবেন, আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিছু হালকা বোধ করলাম। তাদের বাড়তি আয়ের ব্যবস্থার চেয়েও আমার মানসিক কষ্ট কিছুটা লাঘব হলো। তবে তাদের বাড়তি এত সরঞ্জামে আমাদের কক্ষটা একটা গুদামঘর হয়ে গেল। হোক না, তাতে কী। চাদর দিয়ে গুদামের অংশটা আলাদা করে রাখলাম। আমাদের ব্যয়ে শ্যালক থাকবে, গায়েমায়ে শোধবাদ ধরে নিয়ে নিজেকে নিজে মুক্ত করলাম। ছোট ঘরটায় প্রথম দিকে ভাড়া ছিল সাকুল্যে একশটাকা, সর্বশেষ নান্নিরা চলে যাওয়ার সময় ২৫০ টাকা। সে হারে আমার বাড়তি সুবিধে থাকল না। বড় ঘরটা ৯০০ টাকায় ভাড়া দেয়া হল। শ্বশুর সাহেব চাল পাঠাতে চেয়েছিলেন, না করেছি। আমি যখন সোবহানবাগ কলোনিতে আলাদা বাসায় থাকা শুরু করি, তখন তিনি একবার তাদের দেশের থেকে আনা লাল বিরুই চাল ৫ কেজি নিয়ে এসেছিলেন সম্মান করে। ওই প্রথম, ওই শেষ, আর আনতে দেইনি।
কুরবানির ঈদ এলো। আমি কুরবানি দেইনি। আর্থিক বিবেচনাটা বড়। মামাতো ভাই আইয়ুব খান ঈদের দ্বিতীয় দিন গরু জবাই করতেন। দেখি বেবীট্যাক্সিতে করে গরুর আস্ত একটা রান নিয়ে হাজির। বললেন, তুমি কোরবানি দাওনি, এটা মামাতো ভাইয়ের শুভেচ্ছা। গোটা রান। আমরা মানুষ আড়াই জন। শ্যালকও সরারচর চলে গিয়েছে। কাটবে কে? তিনি বললেন, কাটার মানুষ আমি নিয়ে এসেছি। একেবারে কেটেকুটে টুকরো টুকরো করে দিয়ে গেলেন। আমার কান্না পেল, এখন এসব কথা লিখতে গিয়েও আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে। কী আন্তরিকতা আমার ভাইয়ের। যৎসামান্য চা-নাস্তা খেয়ে উনি চলে গেলেন। যাওয়ার আগে বললাম, ভাই, আপনি আমাকে এত স্নেহ করেন, আমি কিভাবে আপনাকে ভুলব। কিন্তু আপনার একটা কাজ আমাকে অখুশি করেছে। আমার আজীবন মনে থাকবে। আরো একজন করেছে, তা-ও আমার মনে রয়ে গেছে। তিনি বুঝে ফেললেন, বললেন, আমরা তোমার দাওয়াত নিয়ে আসব বলে আসিনি। আমি দুঃখিত। বললাম, তখন বাসায় আমার শ্বশুর-পরিবার ছিল। কত বড় মুখ করে আপনাদের আসতে বলেছিলাম, আমার শাশুড়িও খুশি হয়েছিলেন। তারা কষ্ট পেয়েছেন। আমি যদি আপনার এ মাংস ফেরত দিতাম আমার বেয়াদবি হতো, তাই প্রতিশোধ নিলাম না। তিনি আর একটা কথাও বললেন না, সোজা বেবীট্যাক্সিতে উঠে কসাই নিয়ে চলে গেলেন।
ঢাকাইয়া স্টাইলে তার মেহমানদারি ছিল। তার বড় ছেলের মুসলমানি আর বড় মেয়ের কানফুড়ানো উপলক্ষে জিন্দাবাহার লেনে একটা বাড়িতে, তাদেরই আত্মীয়ের, অনুষ্ঠান করলেন। বাসায় এসে দাওয়াত দিয়ে গেলেন। তিনি দাওয়াত দিতে আসার সময় আম-কাঁঠাল-মিষ্টি যখন যা থাকে প্রচুর নিয়ে আসতেন। ছেলের বিয়ের/মেয়ের বিয়ের সময়ে একই রেওয়াজ পালন করতেন। সাথে তার একজন সহকারী থাকতো সব সময়ে। দামি দামি জিনিস আনতেন। বলতেন, আমার বাসায় শুধু নয়, সব বাসায়ই তিনি একই রেওয়াজে নেন। আমার জন্য আনলে তিনি বেশি খুশি হন। তিনি জেনেছেন, খোঁজ নিয়েছেন, বদিউর ঘুষ খায় না, দু’নম্বরী করে না। একদিন বললেন, বদিউর, ভাই, ঠিকাদারী করতে গিয়ে পচে গেছি। ঘুষ দেওয়া ছাড়া টিকে থাকা মুশকিল। ব্যবসা গুটিয়ে ফেলার চেষ্টা করব। ছেলেমেয়ের অনুষ্ঠানে কী নিয়ে যাব? নিউ মার্কেট থেকে ২০ টাকা করে ২টা ছোট্ট অ্যালবাম কিনলাম দুজনের জন্য। খাওয়ার সে কী মহাআয়োজন। আস্ত আস্ত মুরগির রোস্ট, অঢেল রান্না করা ঝাল মুরগি, বড় মাছ ভাজা, সবজি, তরকারি-কত আইটেম। রান্না হচ্ছেÑ খাওয়া হচ্ছে, পাশে খাঁচায়-খাঁচায় মুরগি মজুদ। বললাম, এতকিছুর কি দরকার ছিল, অপচয় নয়? একটু দূরে নিয়ে বললেন, আগে গরিব ছিলাম তো, হালায় ঢাকাইয়া শ্বশুরের আত্মীয়স্বজন একটু আড়চোখে দেখত, এখন হালায়গো মন ভরে দিলাম। আল্লায় বি টেকা দিছে, খরচ করমু না কেন। হেসে দিলাম। ভাইতো দেখি ঢাকাইয়াও কন। আসার সময় বড় এক টিফিনকারীতে-পাঁচবাটি ভরে দিলেন সবকিছু। মানুষ দু’জন। বউ আবার বাসায় গিয়ে রাঁধবে কেন। সে খাবার আমরা আরো দু’দিন খেলাম। তার ছেলের বিয়েতে নয়াবাজার বড় একটি কমিউনিটি সেন্টারে শান-শওকতের খাবার-দাবার দেখলাম। আমার ধানমন্ডির ৩ নং রোডের সরকারি বাসায়ও এসেছিলেন। কিন্তু অবাক হলাম। জীবনে কখনো কোনো তদ্বির নিয়ে আসেননি, এমনকি রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকতেও। একদিন আমি নিজে যেচে বললাম, ভাই, আমার কাছে কি আপনার কোনো কাজ থাকে না? সোজা উত্তর, করি ঠিকাদারী, এসব কাজ টাকার লেনদেনে হয়, তদবিরে অনেক সময়ে ক্ষতি হয়ে যায়। যেখানে যে তরিকা। আর আমার ভাই সৎ আছে, সৎ থাক, তোমাকে ছোট করার প্রয়োজন নেই। পরিচয় দেই বড় মুখে, এতেই যথেষ্ট ইজ্জত পাই। তিনি কলাবাগানে আরেক বড় ঠিকাদারের মেয়ে পড়ানোর জন্য আমাকে টিউশনি যোগাড় করে দিয়েছিলেন।
তবে ১৯৯২ সালে আমি যখন বিজি প্রেসের উপনিয়ন্ত্রক তখন একদিন তিনি আমার অফিসে এসে তাকে দু’লাখ জরুরি ভিত্তিতে উচ্চ সুদে হলেও যোগাড় করে দিতে বললেন, একটা বড় ঠিকাদারী নেবেন। লাখে মাসে আট হাজার টাকা সুদে একদিনের মধ্যে তাকে এক লাখ টাকা নিয়ে দিলাম। আমি নিজে দিলাম এক লাখ টাকা। তিনি ঐ ভদ্রলোককে মাসিক আট হাজার ঠিকই দিয়ে দিতেন। আমাকেও আট হাজার টাকা করে সাধলেন। আমি বললাম, আমাকে লাভ হলে আপনি খুশি হয়ে যা দেন তা-ই নেবো। আট হাজার টাকা করে নেব না। পরে তিনি ওই লোককে এক লাখ টাকা শোধ করলেন, কিন্তু আমাকে লাভতো দূরে থাক, আসল এক লাখ টাকাও দেন না। এ টাকা উসুল করতে আমার প্রায় চার বছর লেগেছিল। তা-ও ৫০ হাজার করে দু’বারে। তার অজুহাত, তার নাকি তখন ব্যবসায়ে খারাপ সময় যাচ্ছিল।
এ জাতীয় আচরণ আমি আরো ২/৩ জন থেকে পেয়েছি। এটা ব্যবসায়ীদের স্বভাব কিনা জানি না। তবে শাহবাগের সিলভানা হোটেলের মালিক অন্য কারো কারো সাথে লেনদেনে এদিক-সেদিক করলেও আমার সাথে পরিষ্কার ছিলেন। তাকে আমি অন্যের থেকে টাকা এনে দিয়ে বর্তমান সিলভানা কেনা, পোস্ট অফিস ছিল যে ওই ঘরটা নবাবদের থেকে দখল কিনে জননী ডিপার্টমেন্টাল স্টোর করার এবং সাতরং দোকানটার দখল কিনে পরে ছোট ছোট দোকান করে অনেক লাভে বিক্রির ব্যবস্থায় টাকার যোগান দিয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একবার তিনি তার নিজের গায়ের একটা জামা আমাকে দিয়ে দিয়েছিলেন। এত লম্বা মানুষের এত বড় জামা আমার সামলাতে বেশ কষ্ট হতো। নিজ চেষ্টায় তিনি মোহাম্মদপুরে সাড়ে তিনকাঠার ওপর একটা বাড়িও করেছেন। দুই সংসারের তার ৬ ছেলে, তিন মেয়ে। কঠোর পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন। মানুষ পটাতেও ওস্তাদ ছিলেন। নিজ পরিশ্রমেই তিনি হোটেল করে এতদূর এসেছেন। এত পরিশ্রমী মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। আনোয়ার খান মডার্ণ হাসপাতালে ইনটেনসিভ কেয়ারে মারা যাওয়ার একদিন আগে প্রফেসর ডা. মবিন খানের সাথে তাকে বেডে দেখে এলাম। এই সেই খায়ের সাহেব, নির্জীব শুয়ে আছেন কিছু যন্ত্রের মাঝে! মবিন খান বললেন, আজও হয়তো রাখা যাবে। সবাই মানসিক প্রস্তুতি রাখুন। পরদিন তার জানাজায় হাজির হলাম। আমার মামাতো ভাই আইয়ুব খান যেদিন মারা গেলেন সেদিন আমি গ্রামের বাড়িতে। অদৃষ্ট কাকে বলে, তার লাশ দেশে নেয়া হলো, মাইকিং করা হলো। আমাদের বাড়ির পাশ দিয়েও মাইকিং করে গেছে, আমরা বোধহয় খেয়াল করিনি। আমি তার জানাজায় যেতে পারলাম না। পরে শুনে তার কুলখানিতে হাজির হলাম। কবর জিয়ারত করে এলাম। এখনো আমি ভাবী এবং বাচ্চাদের খোঁজ-খবর নিই।
মঞ্জুপার জামাই, দুলাভাই ১/১১-এর সময়ে নির্যাতিত হয়েছিলেন মর্মে তাদের এক আত্মীয় আমাকে পরে জানালেন। তার প্রশ্ন, আমি কি দুলা ভাইকে অন্তত নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে পারতাম না। আমার সোজা উত্তর, আমাকে কেউ কিছু বলেনি। বললে অবশ্যই আমি চেষ্টা করতাম। মঞ্জুপার আব্বা, বড় খালু-শ্বশুর, জিপিও থেকে তার চাকরি চলে যাওয়ার বিষয়ে বিয়ের অনেক পরে একবার আমাকে বলেছিলেন, কিছু করা যায় কিনা। আমি যতটুকু অনিয়ম তার পক্ষে হয়েছে জেনেছিÑ তাতে আমার চেষ্টা করার কোনো সুযোগ ছিল বলে আমি মনে করিনি। আমি এতদ্বিষয়ে চেপে গেছি। খালুর তখন তেজগাঁও রেলস্টেশনের পশ্চিম পাশে চারতলা বাড়ি। নিজেরাও থাকেন এবং ভাড়াও দেন। তবে বাড়িটার প্রবেশপথ এত সরু ছিল যে, একটা রিকশাও প্রবেশ করতে পারত না। পরে ওই বাড়ি বিক্রি করে তিনি মিরপুর-১১-এ নতুন করে বাড়ি নির্মাণ করেন। ওই বাড়িতেই বড় খালা শাশুড়ি-মঞ্জুপার মা ইন্তেকাল করেন। ঐদিন প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী শামস কিবরিয়া সিলেটে বোমায় নিহত হন। পরে খালুদের ঐ বাড়িও বিক্রি হয়ে যায়। খালু শেষ বয়সে বেশ অসুস্থ এবং অনেকটা ভাঙ্গা পা নিয়ে চলাচলে অক্ষম হয়ে পড়েন। এক সময়ে ফার্মগেট সুপারমার্কেটে খালুকে একটা ঘড়ি দোকান করতেও দেখেছিলাম। মঞ্জুপার জামাইও তেজগাঁও স্টেশনের পাশের বাড়ি বিক্রি করে ডিওএইচএস (মহাখালী)-এ ভাড়া বাসায় উঠেন এবং ঐখানে তার শেষ জীবিত অবস্থান। তাকে স্কয়ার থেকে বঙ্গবন্ধুতে স্থানান্তরের জন্য আমি কিবরিয়া ভাইকে টেলিফোন করলাম, আইসিইউতে সিট পাওয়া যাবে কিনা, ভিসি সাহেবকে অনুরোধ করতে হবে কিনা। কিবরিয়া ভাই বললেন, আমি দেখছি। তিনি আইসিইউতে সিটের ব্যবস্থা করলেন। দুলাভাইকে বঙ্গবন্ধুতে স্থানান্তর করা হলো। কিন্তু আমার কিবরিয়া ভাই অবস্থা দেখে বললেন, আপনাদের মানসিক পরিতৃপ্তির জন্য হয়তো নিয়ে এসেছেন। তাকে রক্ষা করা কঠিন হবে, বাকিটা আল্লাহর হাতে। এ রাতটা টিকে গেলে ভরসা হতে পারে, কিন্তু মনে হয় না। দুলাভাই মারা গেলেন।
এই ছিল আমার কিবরিয়া ভাই। তিনি আমার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কক্ষে প্রবেশ করলেন। বসলেন। বললেন, বদি ভাই, বঙ্গবন্ধুতে যোগ দেব? সরকারি চাকরি ছেড়ে দেব? আমি জানতে চাইলাম, ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে কিনা। তিনি জানালেন, হয়েছে। বললাম, স্বেচ্ছা-অবসরের দরখাস্ত করে দিন। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি-প্রোভিসি অনেকটা রাজনৈতিক পদ। এখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে বলা চলে। চেয়ারম্যান তো হতে পারবেন। সরকারি মেডিকেল কলেজে বড় জোর কোথাও পরিচালক হতে পারবেন, তাও রাজনৈতিক ব্যাপার-স্যাপার আছে। শুধু প্রফেসর হয়ে থাকার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, পরে চেয়ারম্যান হওয়া কি উত্তম হবে না? চেয়ারম্যান কোনো কারণে হতে না পারলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ভালো শোনায় না? তিনি সাথে সাথে বললেন, সিদ্ধান্ত ফাইনাল। তবে আমার সরকারি পাওনা মন্ত্রণালয় থেকে তাড়াতাড়ি করে পাইয়ে দেয়ার দায়িত্ব আপনার। আমি বললাম, এটা কোনো ব্যাপার নয়। মন্ত্রণালয় শুধু আপনার আদেশগুলো করে দেবে, এ নিয়ে আপনার চিন্তার কারণ নেই, আপনার বদি ভাই আছে না! তার কাজ মন্ত্রণালয়ে যথাসময়ে অতিদ্রুত আমি করিয়ে দিলাম। কিবরিয়া ভাই বঙ্গবন্ধুতে যোগ দিলেন। শমরিতা হাসপাতালে তার চেম্বার ঠিকই রইল। তার মৃত্যুর আগে, করোনার কিছু আগে আমি শমরিতাতে আমাদের গ্রামের এক ছেলেকে ভর্তি করিয়ে অপারেশন করালাম। প্রফেসর পি কে সাহাকে অনুরোধ করে সার্জন ফিস অন্যদের ১ লাখ বিশ হাজার টাকার পরিবর্তে মাত্র ষাট হাজারে করে নিলাম। শমরিতার খরচে কিবরিয়া ভাই এমডি হারুন সাহেবকে বলে দশ হাজার টাকা কমিয়ে দিলেন। আমি সৌজন্য সাক্ষাতে গেলাম সন্ধ্যার পর তার চেম্বারে। তিনি ড্রয়ার খুলে মুঠ করে অনেকগুলো কলম বের করে আমাকে দিলেন। বললাম, ভাই কি এখন কলমের দোকানও দিয়েছেন? হেসে উত্তর দিলেন, যুগান্তরে আপনার কলাম পড়ি। লিখতে কলম লাগে। এগুলো আমাকে সৌজন্য দেয় লোকজন। আমিও আপনাকে দিলাম। তার দেয়া কলমগুলো আমার নিকট ড্রয়ারে এখনো সযতেœ রক্ষিত। আমি তার কলম দিয়ে লিখব ইনশাল্লাহ। মনে পড়ে, আমার লেখার বড় ভক্ত ছিলেন। পড়েই টেলিফোন করতেন। করোনার উপর লেখা পড়েও টেলিফোন করলেন। সাবধানে থাকতে বললেন।
ড. সা’দত হুসেইন তার কেমন মামা হন, আমি সঠিক জানি না। আমি কেবিনেটে জয়েন্ট সেক্রেটারি থাকতে ড. সা’দত সেক্রেটারি। একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, মামার সাথে যাচ্ছে কেমন? বললাম, আপনার মামা সম্পর্কে বাইরে যেমন বেশ উচ্চভাব আছে, আমি তেমন দেখি না। তাকে আমার তেমন ভালো লাগে না। আগেও আমি দু’কেবিনেট সেক্রেটারির সাথে কাজ করেছি, দেখেছি। আমার সাথে ড. সা’দতের কিছু ক্ষেত্রে মিলেনি। অবশ্য সা’দতও তার প্রতিশোধ নিয়েছেন। আমাদের ব্যাচের প্রথমবার সচিব পদে পদোন্নতিতে ঠিক আমার উপরের জন পর্যন্ত দিয়ে থেমে গেছেন। তারপরতো আমাকে ‘আলীমনা’ চিহ্নিত করে খালেদার মেয়াদে আর পদোন্নতিই দেয়া হলো না। আমিও ৮ মাস ছুটিতেই থেকে গেলাম। তত্ত্বাবধায়কের আমলে পদোন্নতি দেয়া হলো। এতদ্বিষয়ে ‘পদোন্নতি বঞ্চনা’ বইতে কিছু আলোকপাতও করেছি। তবে কেবিনেট সেক্রেটারি হিসেবে, আমার কথা বাদ দিলেও, আমাদের ব্যাচের আমার উপরের কয়েকজনকে পদোন্নতি বঞ্চিত করাতে ড. সা’দত ন্যায় বিচার করতে পারেননি। নির্লজ্জের মতো বছরভিত্তিক দু’বার ঠিকাদারী নিয়োগ নেয়ার পরও আবার তৃতীয়বারের আশায়, মেয়াদ শেষের পরদিনও অফিসে এসে বসেছিলেন। পরে খালেদা জিয়া ডেকে নিয়ে চা খাইয়ে বিদায় করলেন। করোনাকালে, অবশ্য করোনায় নয়, ২২ এপ্রিল, ২০২০ ড. সা’দত অচেতন অবস্থায়ই ইউনাইটেড হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করলেন। হাসপাতালে ভর্তির পরদিনই কিবরিয়া ভাই আমাকে টেলিফোনে জানান। দেখতে যাওয়ার সুযোগ নেই তা-ও বললেন। আইসিইউতে অচেতন ছিলেন কয়েকদিন। মৃত্যুর দিন তিনেক আগেও কিবরিয়া ভাইকে টেলিফোন করে ড. সা’দতের অবস্থা জানতে চাইলাম। কিবরিয়া ভাই বললেন, মিরাকেল কিছু না ঘটলে কোনো আশাই নেই। অতিরিক্ত সচিব আফতাব আহমদের এক ভায়রা ওই হাসপাতালের ডাক্তার। আফতাবের মাধ্যমে তার থেকেও খবর নিলাম। দেখতে যেতে পারলাম না, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কাউকে যেতে দিচ্ছেন না। আমার প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিব এম কেরামত আলীকে তার ৩৮, ইন্দিরা রোডের বাসভবনে দেখে এসেছিলাম। আমার দ্বিতীয় মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোঃ মহবুব-উজ-জামানকে বিদেশে নেয়ার আগে স্কয়ার হাসপাতালে দেখে এসেছিলাম। দু’জনের সাথেই কথা বলতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমার তৃতীয় মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. সা’দতের অসুস্থতায় তাকে পরিস্থিতির কারণে দেখতে যেতে পারলাম না। তবে টেলিভিশনে তার সাথে বেশকিছু টকশোতে ছিলাম। প্রথম দু’জন মন্ত্রিপরিষদ সচিব নিয়ে আমি স্মৃতিচারণ লিখে পত্রিকায় প্রকাশও করেছিলাম, কিন্তু ড. সা’দতের ওপর ফাঁকে-ফুঁকে মন্তব্য করা ছাড়া লেখা হলো না। কেরামত আলী সাহেবের এবং মহবুব-উজ-জামান সাহেবের কুলখানিতে গিয়েছি, করোনা হলেও ড. সা’দতের জানাজায় শরিক হলাম, তার মৃত মুখ দেখলাম। এ জানাজায় সাবেক সচিব মোফাজ্জল করিম, আইয়ুব কাদরী এবং মুয়ীদ চৌধুরীর সাথে দেখা হলো, কথা হলো। মোফাজ্জল করিম সাহেবের সাথেও টিভি টকশো করেছি। ড. সা’দতের জানাজায় নামাজ পড়ালেন সিটিং কেবিনেট সেক্রেটারি খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, বক্তব্যও রাখলেন তিনি, মুনাজাতও করলেন তিনি। এটাও একটা বড় সম্মান। ড. সা’দতের নিকুঞ্জের বাসাও প্রথমবারের মতো দেখলাম, তার ছেলেকেও প্রথম দেখলাম। তার স্ত্রী এবং ছোট মেয়েকে ২০০৯ সালে একবার দেখেছিলাম, আমরা তিনজন একসাথে বিমানে বসেওছিলাম। ছোট মেয়ের সাথে কথা বলে এলাম। সা’দতের মৃত্যুর সময়ে তার স্ত্রীও আয়েশা মেমোরিয়ালে ভর্তি ছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর ২০ দিন পর স্ত্রীও মারা যান।  [ চলবে ]

(সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ প্রকাশিত)