সোমবার, ০২-অক্টোবর ২০২৩, ০৫:৩৭ অপরাহ্ন

ডোমুরুয়া থেকে সচিবালয়

shershanews24.com

প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১২:৩৫ অপরাহ্ন

সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজের সৌজন্যে, গত সংখ্যার পর: স্বামীর মৃত্যুর খবর তাকে তখন জানানো হয়নি। এসব খবরই আমাকে কিবরিয়া ভাই দিলেন। কিন্তু কিবরিয়া ভাই নিজের বিষয়ে আমাকে কিছুই জানালেন না। ড. সা’দতের জানাজায় যাচ্ছি শুনে কিবরিয়া ভাই নিজে যাচ্ছেন না বলে আমাকে বারবার সাবধান করলেন। আমার মনে প্রশ্ন জাগে, কিবরিয়া ভাই নিজে কি সাবধান ছিলেন না? তার তো অসাবধান হওয়ার কথা নয়।
মৃত্যু অবশ্যই নির্ধারিত। যেতেই হবে, কারো রেহাই নেই। এটা স্বয়ং আল্লাহর কথা। কুল্লু নাফসিন জায়েকাতুল মাউত। আবার কুল্লু মান আলাইহা ফাআন। একমাত্র আল্লাহর সত্ত্বা অবিনশ্বর। তারপরও অনেকের মৃত্যু পীড়া দেয়। ড. সা’দতের জানাজার পর ২৯ এপ্রিল ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর জানাজা পড়ে এলাম ধানমন্ডি ঈদগাহ মসজিদে। করোনায় নয়। বৃষ্টির কারণে ঈদগাহ’র পরিবর্তে মসজিদেই বাদ জোহর জানাজা হলো (বুধবার)। ইত্যবসরে করোনায় ডাক্তার, আমলা, পুলিশ, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ কত পেশার কত লোক মারা গেল! ১৭/৬/২০ তারিখ পর্যন্ত এ মৃত্যুর সংখ্যা ১,৩০৫ বাংলাদেশে। বিশ্বে এ সংখ্যা ৪ লাখ ৬৫ হাজার ছাড়াল এবং ২০/৬/২০২০-এর মধ্যে। আমার সাথে কাজ করেছেন বাংলাদেশ সার্ভিসেস লিমিটেডে, মোঃ বজলুল করিম, অবসরের একদিন আগে সচিব হলেন, ১৯৮৫ ব্যাচের, আমার হাতেই নিয়োগÑ মারা গেলেন করোনায়। বজলুল করিম ১৯৭৭ ব্যাচের সচিব ওসমান গণি ভাইয়ের জামাতা। যুগ্মসচিব ফখরুল কবির চলে গেলেন করোনায় মাত্র ৫৫ বছর বয়সে। ১৩ জুন চলে গেলেন মোহাম্মদ নাসিম এবং ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ। ১৫ জুন চলে গেলেন সিলেটের জনতার মেয়র খ্যাত বদরুদ্দীন আহমদ কামরান (প্রাক্তন)। ২০/৬/২০২০ তারিখে চলে গেলেন কামাল লোহানী। প্রথম আলো ১৭ জুন থেকে শ্রদ্ধা জানিয়ে মৃত অনেকের ছবি ছাপছে। আমরা আরো মৃত্যু হয়ত দেখব। তারপরও করোনা কি মানুষকে সরল পথে আনতে পারছে? উত্তর হচ্ছে, না। যেকোনো দিন আক্রান্ত হলে আমিও চলে যাব, সে প্রস্তুতিই আমার আছে। বিশ্বে প্রতিষেধক যেহেতু এখনো আবিষ্কার হয়নি, ভাগ্যকে মেনে নিতেই হবে। আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভাগ্যের এ নির্মম পরিহাসটাও মেনে নিতে হবে যে, এখানে করোনায় আক্রান্ত সকলে চিকিৎসার সুযোগ হয়তো পাবেন না। এমনও খবর বেরিয়েছে যে, ৪/৫ হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে ভর্তি হতে না পেরে কেউ হয়তো অ্যাম্বুলেন্সেই, কেউ হয়তো রাস্তায়ই, কেউবা হয়তো শেষতক বাসায় ফিরেই বিনা চিকিৎসায় মরে গেলেন। কিছু ডাক্তারও যে ডাক্তারের মা-বাবা কিংবা নিকট-আত্মীয়কে হাসপাতাল সেবায় নিতে ব্যর্থ হয়েছেন সে খবরও আমরা পত্রিকান্তরে দেখলাম। 
করোনায় মানবিকতার, আত্মীয়তার, মায়া-মমতা-স্নেহ ভালোবাসার চরম পতনের আরেক পরাকাষ্ঠাও আমরা দেখলাম। মাকে জঙ্গলে রেখে এলো সন্তান। সারাজীবন যে স্ত্রী-সন্তানদের খাবার যোগাড়ে নিজেকে তিলে তিলে শেষ করেছেন যে মানুষটি, করোনা হয়েছে জেনে গভীর রাতে সে মানুষটিকেই ঘরে ঢুকতে দিলেন না তার স্ত্রী-সন্তানেরা। দূরবর্তী গ্রামে এক বোনের বাড়িতে গিয়ে তাকে মরতে হলো। মৃত্যুর পর কবরে/শ্মশানে নেয়ার লোক নেই। আপনজন, নিজের সন্তানরাও কাছে যান না, অগত্যা পুলিশকে এসে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দাফন করতে হলো। ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে মুখাগ্নি করে দাহ করতে হলো। এটা তো সেই হাশরের দিনের আলামত মাত্র। যেদিন মা-বাবা সন্তান চিনবেন না, সন্তান মা-বাবা চিনবেন না, সবার ইয়া-নাফসি ইয়া-নাফসি অবস্থা। অবস্থাটা আগে নিজে বাঁচলে পরে বাপের নাম। এত ক্ষমতা, এত ধনসম্পদ, এত এত আপনজনÑ সবই হয়ে যায় পর, কোনোকিছুই কোনো কাজে আসে না। তারপরও মানুষের লোভ শেষ হয় না, মোহ কাটে না, মানুষ সুযোগ পেলেই ধনস্পদ বাড়ানোর পেছনে ছুটছেতো ছুটছেই। শেষ নিঃশ্বাস না যাওয়া পর্যন্ত তার এ ছুটার শেষ নেই যেন। এমন লোকও দেখছি, অঢেল সম্পদ অথচ ভালো কিছু খেতে পারে না, অন্যের খাবার খাওয়া দেখে চেয়ে থাকে। আল্লাহ তার রিজিক উঠিয়ে নিয়ে গেছেন। তারপরও সে আরো চাই, আরো চাই করে করে ছুটছে তো ছুটছেই। কেউ হয়তো আল্লাহর দেয়া এ সম্পদ থেকে ঠিকমতো যাকাতও দিচ্ছে না। বড় বখিল, বড় কৃপণ, গরিব-দুঃখীকে দিচ্ছে না, দিলেও তা শুধু কমই নয়, নিম্নমানেরও। আল্লাহ কুরআন শরিফে মানুষের এমন চরিত্র নিয়ে বারবার বলেছেনÑ মানুষ বড় কৃপণ, আমার দেয়া সম্পদ থেকে সে অন্যের জন্য খরচ করতে চায় না। মানুষ বড় অকৃতজ্ঞÑ সে সম্পদ পেলে আমাকে ভুলে যায়, তার সম্পদ নিয়ে গেলে আবার কান্নাকাটি করে। মানুষ বড় স্বার্থপর। আমি বলি মানুষের এ চরিত্রতো আল্লাহরই সৃষ্টি। সৃষ্টির রহস্য এখানেই। সমস্যা হলো, আল্লাহ যে মানুষকে ভালো-মন্দ, বিচার-বিবেচনার ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছেন, শিখিয়ে দিয়েছেন। তাই আল্লাহ এভাবে বানিয়েছেন বলে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। ভালো-মন্দ বিচারের জন্য প্রত্যেক মানুষের মধ্যে যে বিচারিক ক্ষমতা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন দিয়ে রেখেছেন, ওটা প্রয়োগ করলেই আর সমস্যা হতো না। কিন্তু তা যে হয় না। হয়তো হয় না এজন্য যে, তাহলে আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করবেন কেন, ফেরেস্তা দিয়েইতো ভালো চলছিল। মানুষ পাপ না করলে আল্লাহর কাছে মাফ চাইবে কে, আল্লাহই বা ক্ষমা করবেন কাকে, তিনি গাফুরুর রহিমই বা হবেন কিভাবে! এসব নিয়ে ভাবা আমার সাধ্যে নেই। আমি বলি এবং বুঝি, আমার বিচার করতে আল্লাহর এক সেকেন্ডের কোটি কোটি কোটি কোটি... ভাগের এক ভাগ সময়ও নষ্ট করার প্রয়োজন নেই। আমাকে যে যৎসামান্য বুদ্ধি-বিবেচনা আল্লাহ দিয়েছেন, তা দিয়ে আমিই আমার বিচার করতে সক্ষম। কোনটা ভালো করেছি, কোনটা খারাপ করেছি; কোনটা জেনেও ঠিকমতো করিনি, কোনটা জেনেও গুণাহর কাজ করছিÑ সবইতো আমার জানা। মনকির-নাকিরের হিসাবের খাতার কী প্রয়োজন? তারপরও আমরা ভুল করি, পাপ করি, ক্ষমা চাইব, হয়তো ক্ষমা পাবও। আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হতে নেইÑ সেটাই ভরসা। করোনা মহামারি থেকে আল্লাহ রহমত না করলে আমাদের রক্ষা নেই। আমরা ক্ষমা চাই, আমরা আল্লাহর রহমত চাই।


আবারো কিবরিয়া ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি তো সকল ঈদ নিজ ফেনীর বাড়িতে করতেন। এটা একটা বড় গুণ। আমাদের অনেকে গ্রাম ছেড়ে কপালগুণে শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর ঈদে-চাঁদেও তেমন গ্রামমুখী হতে চান না। নিজের অতীত ভুলে যান। কী ছিলেন আর কী হলেন, সেটার খেই হারিয়ে ফেলেন। গ্রামের গরিব মানুষর কাছে, আত্মীয়স্বজন থেকে অনেকে কেমন যেন দূরত্বে চলে আসেন। কিবরিয়া ভাই সেটা করেননি। আর আমি দু’ঈদের কোনো একটাতে যাওয়ার চেষ্টা করি, তা-ও সবসময় পারি না। তবে রজমানে এবং কুরবানির সময় সবার খোঁজ নিই। সাধ্যমতো সাহায্যের চেষ্টাও করি। ২০১৯ সালের রমজান মাস প্রায় পুরোটা গ্রামে কাটিয়েছি। গত ১০/১২ বছর যাবত তারাবির নামাজ আমি একদিন এক এক মসজিদে আদায় করি। আল্লাহর অশেষ রহমত যে, বৃষ্টি-বাদল যাই হোক তিনি রহমত করেন। আল্লাহর ইবাদত করার জন্যও আল্লাহর রহমত দরকার। গ্রামে এক দিন এক মসজিদে খতম-তারাবি আদায়ের জন্য মসজিদ পাওয়া কষ্টকর হতে পারে, সব মসজিদে খতম-তারাবি হয় না। দূরে কোথাও যেতে হলে সময়েও কুলোয় না। তাই গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম। আল্লাহর অশেষ রহমত, লক্ষ্মীয়ারা, সিন্দুরপুর, জয়নারায়ণপুরÑ সব এলাকা ঘুরে বড় ভাইসহ খতম-তারাবি আদায় করছিলাম। কিন্তু তারালিয়া মসজিদে তারাবির সময়ে ভীষণ পেট মোচড়ানোতে বাথরুমে চলে আসতে হলো। তারাবিতে ২০ রাকাতে ছুট পড়ে গেল। এটাও একটা বড় শিক্ষা। আল্লাহ রহমত করেননি। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে কুরবানির ঈদে গেলাম। সকাল-সকাল চলে গেলাম। বাড়ি না গিয়ে সোজা গেলাম কিবরিয়া ভাইয়ের বাড়ি। তাদের গরুর মাংস কাটা হচ্ছিল। আমাকে দেখে তো তিনি অবাক হলেন। এত সকালে তার বাড়িতেÑ যেন তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। বললাম, কিবরিয়া ভাই, নামাজতো পথে পড়েছি, প্রথম খাবার আজ আপনার সাথে। তিনি যার পর নাই খুশি হলেন। চালের গুড়ির পিঠার সাথে (স্থানীয়ভাবে আমরা বেইল্লা পিঠা বলি) কুরবানির মাংস দিয়ে খেলাম পেটপুরে।
গ্রামে এ রেওয়াজ আগেও ছিল। কুরবানির পশু জবাই করে প্রথমে ফুসফুস, কলিজা, গিলা বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হতো। মাংস বানানোর সাথে সাথে ওই কলিজা-গিলাতে পিঠা খাওয়া চলতো। কার আগে কে খাবেÑ অর্থাৎ কাদের গরু আগে রান্না হচ্ছেÑ তার একটা প্রতিযোগিতাও ছিল। গ্রামের আগের মানুষগুলো পাকা কসাই না হলেও গরুর চামড়া ছাড়াতে, মাংস কাটতে অর্থাৎ বানাতে বেশ দক্ষ ছিলেন। গাছের ডালের সাথে রশি দিয়ে বড় বড় চার পা কম সময়েই বড় বড় টুকরো করে নামিয়ে দিতেন। অন্যরা দা-বটি-ছুরি নিয়ে কলাপাতা/পাটির ওপর সেগুলো ছোট ছোট টুকরো করে ফেলতো। অনেক সময় মহিলারাও হাত লাগাতেন। এখনতো কোনো কোনো পরিবারের নিজেদের মাংস কাটার লোক না থাকাতে অন্য লোককে টাকা দিয়ে নিতে হয়।
গ্রামও এখন শহরধাঁচে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আলীর ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ স্লোগানের কয়েক বছর আগেই অনেক অনেক গ্রাম শহুরে হয়ে গিয়েছে। আমাদের এলাকাতো এক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে। আমাদের সেই পঞ্চাশ/ষাটের দশকের গ্রাম এখন আর কই? বাড়ি থেকে বেরুনোর রাস্তা কোথায় ছিল তখন? ছিল না বললেই চলে। আমরা কবরস্থানের পাশ দিয়ে জমির আলের মতো সরুপথে পূর্ব বাড়ির পুকুরপাড়ে উঠতাম। তারপর সরু কাঁচা রাস্তা সোজা পূর্বদিক হয়ে বামে বাঁক নিয়ে কত কত বাঁক দিয়ে গেল নুনের গোলা। পরে শুদ্ধ নাম এলাহিগঞ্জ। ওখান থেকে জগইরগাঁও হয়ে একপথ শর্শাদি, আরেকপথ লক্ষ্মীয়ারা হয়ে ফেনী। বাড়ি থেকে সোজা আবার লক্ষ্মীয়ারাও কাঁচা রাস্তা। খাল পার হয়ে দক্ষিণ দিকে রাজাপুর। মাঝিবাড়ির পশ্চিম পাশের নদী পার হয়ে সরিফপুর হয়ে সিন্দুরপুর। সব রাস্তাইতো কাঁচা। ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তা, পরে ইউনিয়ন পরিষদের। ডিস্ট্রিক বোর্ডের রাস্তাও বলা হতো। প্রতি রাস্তায় কত কত যে ভাঙ্গা, নালা, সাঁকো। নৌকাই ছিল বর্ষাকালের মূল বাহন। শুষ্ক মৌসুমে রাস্তায় হাঁটা গেলেও দূরের পথ, হাটবাজারে যাতায়াত নৌকায়ই। নদীতে-খালে বাঁশের সাঁকো। সব বাড়ি থেকে বাঁশ নিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে এসব সাঁকো হতো। নাপিতবাড়ির পাশে দক্ষিণ দিকে রাজাপুর ঘোনা যাওয়া হয় এখনো সাঁকো পেরিয়ে। আমাদের খালে স্টিল ব্রিজ হলো, আমার চেষ্টায়, স্মরণীয়-বরণীয় কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের বদান্যতায়। রাজাপুর বাজারের উত্তর পাশের নদীতে ৭০ দশকেই ব্রিজ হলো। মোসলেহ উদ্দিন মোক্তার যখন ষাটের দশকে চেয়ারম্যান ছিলেন আমাদের পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের, তখন আইয়ুব খানের বিডি মেম্বাররা দাপুটে ছিলেন। মোক্তার সাহেব একজন স্বনামধন্য চেয়ারম্যান ছিলেন। তার ইউনিয়নে রাস্তাগুলো প্রশস্থ করেছিলেন। সার্কেল অফিসার (ডেভেলপমেন্ট), সংক্ষেপে সিও (ডেভ) এবং সংশ্লিষ্টদের তিনি গুডবুকে রেখেছিলেন, তিনিও তাদের গুডবুকে ছিলেন। কট্টর মুসলিম লীগার হওয়া সত্ত্ব্ওে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আওয়ামীরাই তাকে রক্ষা করেছিলেন। স্বাধীনতার পরও একবার তিনি আওয়ামীদের সমর্থনে চেয়ারম্যন হয়েছিলেন। তাকে নিয়ে আমার একটা লেখা ‘একজন মোসলেহ উদ্দিন মোক্তার জিন্দাবাদ’ যুগান্তরে ১৭ ডিসেম্বর, ২০১১, শনিবার ছাপা হয়েছিল। ছোট ফেনী নদীতে রাজাপুর বাজারের উত্তর পাশের ব্রিজটি তিনিই করিয়েছেন। সে আমলে মাত্র ৭০ হজার টাকা নাকি ব্যয় হয়েছে। ওটা এখনো আছে। এবার নতুন ব্রিজ হবে। সেই কাঁচা রাস্তা পরে আমার চেষ্টায় আমাদের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের মাধ্যমে পাকা হলো। এখনতো গ্রামে-গ্রামে সকল রাস্তা পাকা। আমাদের রাস্তাটি আবার পরে আমার চেষ্টায়, তখনকার সচিব ড. মাহবুবের মাধ্যমে সড়ক ও জনপথ বিভাগের হলো। গত ২০১৮-১৯ এটা আবার মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সদিচ্ছায় প্রশস্থ হলো। মনে পড়ে, তেমুহানী থেকে দরবেশের হাট পর্যন্ত কাঁচা রাস্তা পাকা করার জন্য আমাদের কত-না তদবির করতে হয়েছিল। যে হাটে-বাজারে আমরা নৌকায় যেতাম, এখন মানুষ যায় সিএনজিতে। রিকশাও উঠে গেছে। টেলিফোন করলেই সিএনজি এসে যায়।


বাড়ির বউরাও এখন দোকানের পরোটা খায়। ঢেঁকিতো এখন নেই-ই। ষাটের দশক থেকে ২০২০ কত পরিবর্তন, কত উন্নয়ন, দেশ স্বাধীন না হলে এতো উন্নয়ন হতো না। খালি পায়ের মানুষ এখন নেই, ভিক্ষুকও গ্রামে নেই। তবে কৃষিশ্রমিকও নেই, চাষউপযোগী জমিও অনাবাদী পড়ে থাকে। উত্তরবঙ্গের কিছু শ্রমিক কাজ করে। উৎপাদন ব্যয় বেশি বলে আমার সামান্য কৃষি জমি শুধু ফসল ফলিয়ে নিয়ে যেতেও কেউ রাজি হয় না। কয়েক বছর থেকে অনাবাদী পড়ে আছে। সরকার নিজ উদ্যোগে এসব জমি চাষের ব্যবস্থা করতে পারবে কিনাÑ তা-ই এখন ভাবার বিষয়। খাদ্য আগে, তারপর অন্যসব। গরিব দেশের রাজনীতিতে এ খাদ্যের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ আমাদের তা আরো একবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। পাটতো আমাদের এলাকায় এখন দেখাই যায় না। পেঁয়াজ, রসুন, মসুরি, খেসারি, মরিচ, বেগুন, তরমুজ, বাঙ্গি, গোলআলু, লাল আলু, কলাই-মাঠকে মাঠ যেখানে কত রকমের ফসল হতোÑ সেগুলো যেন এখন রূপকথা। এ নিয়ে আবারো ভাবতে হবে। প্রবাসী শ্রমিক হতে হতে অর্থনীতি বেড়েছে গ্রামে-গ্রামে, কিন্তু হরেক রকম কৃষি উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আমার মনে পড়ে, ছোট থাকতে আমি নিজে মরিচের চারা রোপণ করেছি, ওগুলোতে বদনায় করে পানি দিয়েছি, কোদাল দিয়ে মাটি আলগা করেছি, লেদা পোকা মেরেছি; গোলআলু, লালআলু লাগিয়েছি, তুলেছি; জমিতে হাল দিয়েছি, মই দিয়েছি, ভাদ্র মাসে ধান রোপণ করেছি, ধান কেটেছি, বাড়িতে ধানের বোঝা মাথায় করে এনেছি, গরু দিযে ধান মাড়িয়েছি, কাঠের গুড়িতে পিটিয়ে ধান লয়েছি, গোলায় ভরেছি, ধান ভিজানোতে মাকে সাহায্য করেছি, সিদ্ধ ধান শুকিয়েছি, ঢেঁকিতে চাল ভেনেছি, চালকলেও নিয়েছি। পাটক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করেছি, পানিতে পাট পচিয়ে আঁশ বের করেছি, বাজারে বিক্রি করতেও নিয়েছি; গরুর ঘাস তুলেছি, ঘাস কেটেছি, গরুর গোবর পরিষ্কার করেছি, গোবর জমিয়ে সার বানানো হয়েছে। আব্বার সাথে কত কাজ না করেছি। কী মধুর সে দিনগুলো, কত স্মৃতিময় সে সময়!
কিবরিয়া ভাই খাওয়ার পর তাদের বাড়ির সীমানা, গাছপালা, ভাতিজাদের ঘরÑ সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাকে দেখালেন। কী হৃদ্যতা! মনে হয় যেন আমি জসিমউদ্দীনের কবিতার মেহমান হয়ে গেলাম। ফেরার পথে কিবরিয়া ভাই আমাদের বাড়ির জন্য কিছু বেইল্যা-পিঠা অর্থাৎ চালের রুটি এবং মাংস দিতে চাইলেন। বিনয়ের সাথে রেহাই নিলাম। কিন্তু তার আন্তরিকতার পরিমাপ করব কী দিয়ে? দাঁড়ি-পাল্লায়, স্কেলে কি এটা মাপা যায়? না, কখনো না। তার ওই সাধায় আমার আব্বার কথা আমার মনে পড়ে গেল তখন। আব্বা জীবিত থাকতে আমি যদি কোনো ঈদে বাড়ি না যেতাম, পরে আব্বা চালের রুটি এবং কুরবানির গরুর মাংস আমাদের জন্য ঢাকায় নিয়ে আসতেন। বাড়ির সামনের একটু জমিতে লাগানো কুমড়ো শাকের প্রতি আমার বেশ আগ্রহ ছিল, আব্বা সে শাকও নিয়ে আসতেন। একবার আব্বা বড় এক কাঁঠাল নিয়ে ঢাকা আমার সোবহানবাগের বাসায় হাজির। নিচ থেকে ডাকছেন। আমাদের একটা কাঁঠাল গাছে এত বড় বড় কাঁঠাল ধরতো যে, মাটিতে গর্ত করে ওগুলোকে বস্তা দিয়ে জায়গা করে দিতে হতো। উপরের ডালে তেমন বড় বেশি হতো না। এক এক কোষ বেশ বড় বড়, চাইলা কাঁঠাল, আমার খুব প্রিয়। এখনও আমি কাঁঠাল বেশ খেতে পারি। বললাম, আব্বা, কাঁঠাল কি ঢাকা শহরে আমরা খাচ্ছি না, এখানে সবকিছু পাওয়া যায়। আপনি এত কষ্ট করলেন কেন, ওজনতো ২০ কেজির কম হবে না। আব্বা যেন দোষ খণ্ডালেন। বললেন, আমার কোনো কষ্টই হয়নি। আমিতো কাঁঠালটা একবারও ধরিনি। বাড়িতে বস্তায় করে অন্যরা রিকশায় তুলে দিয়েছে, রিকশাওয়ালা মহিপাল বাসস্টেশনে নামিয়ে দিয়েছে, বাসের লোক ছাদে তুলে দিয়েছে, গুলিস্তান এসে তারাই নামিয়ে দিয়েছে, তারপর রিকশাওয়ালা রিকশায় তুলে নিয়েছে। তোমার বাসার সামনে থেকে তো তুমি তুলছ তিনতলায়Ñ আমার কিসের কষ্ট হলো! আমি আর একটুও কথা বললাম না। তখন আমার বড় ছেলেটা ছোট, বছর ৩/৪ হবে। আব্বা বললেন, তোমার ছেলে বড় হোক, তুমি আমার মতো হও, তুমি গ্রামে যাও আর ওরা ঢাকায় থাকুক, তখন বুঝবে এ কাঁঠাল আনার মধ্যে কত আনন্দ। বড় চিংড়িÑ আমরা ইছা মাছ বলতাম, আমার বড় প্রিয়। মাথায় আঙ্গুল ঢুকিয়ে ইছা মাছের মগজ বের করতাম। আব্বা বাড়ি থেকে তা-ও বুনা করে নিয়ে আসতেন। বলতেন, বাড়িতে আমরা সবাই গাছের ফল-ফলাদি খাচ্ছি, নদীর মাছ খাচ্ছি, তুমিতো নেই, খারাপ লাগে, তাই নিয়ে আসি। আব্বা ১৯৮৩ সালে প্যারালাইজড হওয়ার পরতো আর কেউ এমন করে আনেও না, বলেও না। দুভাই যা-ও একটু পাঠাতো, তাও আমি বন্ধ করে দিয়েছি, আমার স্ত্রীর কিছু কথায়। গত বছর কিবরিয়া ভাইয়ের বাড়ি যাওয়া হয়নি, এ বছর তো করোনায় তিনিও বাড়ি যাননি ঈদে। আমিও যাইনি। তিনি চলে গেলেন কবরে, এখন আমি যাব কবর জিয়ারতে, দোয়া করবো। ৭ জুন, ২০২০ ভাবী ছোট মেয়েসহ ঢাকা এলেন। টেলিফোনে কথা বললাম।
ডাক্তার নিয়ে কথা যখন বলছি আরো একটু না হয় বলি। আমরা ছোট থাকতে তো গ্রামের কবিরাজ, গ্রামের ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা পেতাম। হাতুড়ে বা কোয়াক যা-ই বলা হোক না কেন তারা অনেকেই বেশ অভিজ্ঞ ছিলেন। ওই যে আগে নিকুঞ্জ ডাক্তারের কথা বললাম, আমাদের নিকুঞ্জ মামা, তার তো বেশ নামডাক ছিল। তার রাজাপুরের ছোট কক্ষে কত রোগী যেতো।   [ চলবে ]

 (সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ প্রকাশিত)