
shershanews24.com
প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০৩:২১ অপরাহ্নসাপ্তাহিক শীর্ষকাগজের সৌজন্যে: স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীনে সারাদেশে যে ৮৮৯ জন মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট ও ১৮০০ জন মেডিকেল টেকনিশিয়ান নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছিলো তা অবশেষে বাতিল করা হয়েছে। গত ২০ সেপ্টেম্বর বিকেলে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের প্রশাসন-১ অধিশাখার উপসচিব আনজুমান আরা’র স্বাক্ষরে জারিকৃত এক চিঠিতে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়। নিয়োগ দুর্নীতির ব্যাপারে নিয়োগ কমিটির যে দু’জন সদস্য লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্তে তা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু যাদের দুর্নীতির কারণে বহুল আলোচিত এই নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করা হলো তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত নেয়নি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ফলে এ নিয়ে স্বাস্থ্যখাত ছাড়াও বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। টিআইবি পর্যন্ত এ বিষয়ে এক বিবৃতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি অবিলম্বে নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িতদের শাস্তি দাবি করেছে।
গত বছরের মার্চে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর স্বাস্থ্যখাতে লোকবলের অপ্রতুল্যতা সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। বিশেষ করে মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট ও টেকনিশিয়ানের অপ্রতুল্যতায় মহাসংকট সৃষ্টি হয়। করোনা মোকাবেলায় শুরুতেই প্রয়োজন হয় ব্যাপকহারে করোনা টেস্ট। কিন্তু টেস্ট যারা করবে সেই টেকনোলোজিস্ট ও টেকনিশিয়ানের নিয়োগ হচ্ছিলো না দীর্ঘদিন। ফলে এমনিতেই লোকবলের ঘাটতি ছিলো। করোনা সংক্রমণের পর টেকনোলোজিস্ট ও টেকনিশিয়ানের মহাসংকট দেখা দেয়। এমন পরিস্থিতিতে সরকার নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে লোক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট ৮৮৯ জন এবং মেডিকেল টেকনিশিয়ান ১৮০০ জন নিয়োগের জরুরি অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অথচ সেই জরুরি নিয়োগ দীর্ঘ দেড় বছরেও শেষ করা যায়নি ভয়াবহ দুর্নীতি-জালিয়াতির কারণে। লিখিত পরীক্ষার পর মৌখিক পরীক্ষার চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে আটকে ছিলো গত প্রায় ৬ মাস ধরে। একেতো সময়ক্ষেপণ হয়েছে, লোকবলের অভাবে করোনা প্রয়োজন অনুযায়ী পরীক্ষা করা যায়নি, স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমে ব্যাপক ব্যাঘাত হয়েছে; অন্যদিকে অর্থকড়ি খরচ করে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে হাজার হাজার চাকরিপ্রার্থী মাসের পর মাস অশ্চিয়তায় ভুগেছে। এখন সেই নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল হয়ে গেছে। নতুন করে আবার নিয়োগ পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু যারা এসব অপকর্মের জন্য দায়ী বলে প্রমাণিত হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি।
প্রশ্নফাঁসসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠে লিখিত পরীক্ষা চলাকালেই। এ নিয়ে মিছিল-মিটিংও হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তখন এটি মোটেই আমলে আনেনি। পরবর্তীতে মৌখিক পরীক্ষা চলাকালে খোদ নিয়োগ কমিটিরই দু’জন সদস্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন সুনিদিষ্ট তথ্যপ্রমাণসহ। নিয়োগ কমিটির সদস্যরা লিখিতভাবে সুনির্দিষ্ট করে দুর্নীতি-জালিয়াতির অভিযোগ তোলার পরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রথমে এটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে। পরে গণমাধ্যমে এমন গুরুতর ঘটনার খবর ফাঁসের পর এ নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হলে মন্ত্রণালয় বাধ্য হয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে।
নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিলের বিষয়ে উপসচিব আঞ্জুমান আরা’র স্বাক্ষরে জারিকৃত চিঠিতে বলা হয়েছে- উপর্যুক্ত বিষয়ে জানানো যাচ্ছে যে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের আওতাধীন মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট, মেডিকেল টেকনিশিয়ান ও কার্ডিওগ্রাফার পদে নিয়োগের দুর্নীতির বিষয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের প্রেক্ষিতে তদন্ত করার জন্য স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ কর্তৃক কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি কর্তৃক দাখিলকৃত তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে মাননীয় মন্ত্রী স্বাস্থ্য অধিদফতরের আওতাধীন মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট, মেডিকেল টেকনিশিয়ান ও কার্ডিওগ্রাফার পদে জনবল নিয়োগের বিষয়ে নিম্নোক্ত নির্দেশনা প্রদান করেছেন: “যেহেতু তদন্ত প্রতিবেদনে লিখিত পরীক্ষার খাতায় অস্পষ্টতা পাওয়া গেছে মর্মে উল্লেখ রয়েছে সেহেতু বর্ণিত নিয়োগ কার্যক্রম বাতিলপূর্বক পুনরায় নতুন নিয়োগ স্বল্প সময়ে বিজ্ঞপ্তি প্রদান করে দ্রুত নিয়োগের ব্যবস্থা করা হোক। ইতপূর্বে যারা আবেদন করেছেন তাদেরকে নতুনভাবে আবেদনের প্রয়োজন নেই; তারা নতুন নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন।”
চিঠিতে বলা হয়, “এমতাবস্থায়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের আওতাধীন মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট, মেডিকেল টেকনিশিয়ান ও কার্ডিওগ্রাফার পদে জনবল নিয়োগের লক্ষ্যে মাননীয় মন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।” স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর এই চিঠিটি ইস্যু করা হয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সাবেক এপিএস আরিফুর রহমান এবং অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) শেখ মোহাম্মদ হাসান ইমামসহ একটি বড় সিন্ডিকেট এই দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। আর এ কারণেই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা যাচ্ছিলো না। সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজ ও শীর্ষনিউজ ডটকম-এ এই নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু অবশেষে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করা হলেও নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িত এপিএস আরিফ এবং পরিচালক (প্রশাসন) হাসান ইমামসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
নিয়োগ কমিটির দুই সদস্যের লিখিত অভিযোগে যা ছিলো
অধিদফতরের উপপরিচালক (প্রশাসন) পদে নতুন নিয়োগ পাওয়া ডা. আবুল হাশেম শেখ গত ৮ মার্চ স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে একটি চিঠি দিয়ে এপিএস আরিফ কর্তৃক তাঁকে ঘুষের প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ তোলেন। তখন স্বাস্থ্যসচিবের দায়িত্বে ছিলেন আবদুল মান্নান। চিঠিতে ডা. আবুল হাশেম লিখেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (পরিকল্পনা অধিশাখা) শ্রীনিবাস দেবনাথ গত ১ মার্চ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান। তখনই তিনি ঘুষের প্রস্তাব দেন।
ডা. হাশেম আরও লেখেন, ‘তিনি (শ্রীনিবাস) বললেন শুক্রবারে আপনাকে এক কোটি টাকা দেব, কোথায় দেখা করব? আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী জন্য আমাকে এত টাকা দেবেন? তিনি জানালেন, আমরা যে তালিকা দেব, তাঁদেরকে ভাইভা বোর্ডে পাস করিয়ে দিতে হবে। তাঁরা লিখিত পরীক্ষায় ভালো করেছেন।’
সেদিনের সাক্ষাৎকালে উপসচিব শ্রীনিবাস উপপরিচালক ডা. হাশেমকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) পদে পদোন্নতির লোভ দেখান বলেও উল্লেখ করা হয় চিঠিতে। এতে ডা. হাশেম আরও লেখেন, কথা বলার সময় শ্রীনিবাসের মুঠোফোনে একটি ফোন আসে। শ্রীনিবাস ফোনটি তাঁকে দিয়ে বলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এপিএস কথা বলবেন। তখন আরিফুর নামে একজন বলেন (ডা. হাশেমকে), তিনি যেভাবে বলেছেন সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে।
চিঠিতে ডা. আবুল হাশেম স্বাস্থ্যসেবা সচিবকে বলেন, ‘আমি শ্রীনিবাস দেবনাথকে জানালাম, ঘুষের বিনিময়ে কোনো কাজ করতে অপারগ। তিনি জানালেন, এক কোটি টাকা শেষ নয়, নিয়োগের পরে আরও পাবেন, চিন্তা করে দেখুন।’
ডা. হাশেমের চিঠিতে অভিযোগ করা হয়, শ্রীনিবাস দেবনাথ অনেকের সঙ্গে জড়িত হয়ে নিয়োগ-বাণিজ্য পরিচালনা করেন। চিঠিতে ডা. হাশেম নিয়োগ-বাণিজ্যের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে স্বাস্থ্য খাতকে দুর্নীতিমুক্ত করার অনুরোধ জানান স্বাস্থ্যসেবা সচিবকে।
উল্লেখ্য, শ্রীনিবাস এবং আরিফুর দুজনেই ইকোনমিক ক্যাডারের কর্মকর্তা ছিলেন। আরিফুর রহমান সেখ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের এপিএস পদে ছিলেন। নানা অনিয়মের অভিযোগে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আরিফুর রহমান সেখ বর্তমানে পরিকল্পনা বিভাগে সিনিয়র সহকারী প্রধান পদে কর্মরত আছেন। কিন্তু বাস্তবে আরিফুর রহমানই এখনো স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এপিএস হিসেবে পরিচিত স্বাস্থ্যখাতে। দীর্ঘদিন জাহিদ মালেকের পিএস-এপিএস পদে কাজ করার সুবাদে ওই পরিবারের সঙ্গে এক ধরনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে আরিফুর রহমানের। মন্ত্রীর বাসায় এখনো নিয়মিত তার যাতায়াত রয়েছে। মন্ত্রীর ছেলের সঙ্গে যৌথভাবে গোটা স্বাস্থ্যখাত দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছেন এই আরিফুর।
এই নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় অনিয়মের বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব ও নিয়োগ কমিটির সদস্য শারমিন আক্তার জাহান গত ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ স্বাস্থ্যসেবা সচিবকে যে চিঠি দেন তাতে তিনি উল্লেখ করেন, নিয়োগ কমিটির সদস্য ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব দীপঙ্কর বিশ্বাসের প্রস্তাব ও কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগকে লিখিত পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়।
শারমিন আক্তার জাহান লিখেন, লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র অত্যন্ত কঠিন ছিল। কঠিন প্রশ্নেও উত্তীর্ণদের বেশির ভাগ অনেক ভালো নম্বর পান। কিছু খাতা খুলে দেখা যায়, মুক্তার মতো হরফে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত লেখা, যেখানে কলম ধরার কোনো সুযোগ নেই। এত নম্বর পাওয়া খুবই অপ্রাসঙ্গিক ছিল।
চিঠিতে শারমিন আক্তার আরও উল্লেখ করেন, মৌখিক পরীক্ষা শুরু হলে দেখা যায়, যাঁরা অনেক নম্বর পেয়েছেন, তাঁরা মৌখিক পরীক্ষার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছেন না। যাঁরা ৪০ থেকে ৫৯ পর্যন্ত নম্বর পেয়েছেন, তাঁরা অনেক ভালো মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছেন। তিনি দাবি করেন, বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছেন, পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা করে নেওয়া হয়েছে।
শারমিন আক্তার চিঠিতে বলেন, ‘বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর। এ বিষয়ে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।’
এসব অভিযোগ স্বাস্থ্যসচিবকে জানানো হলে তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানান। এরপর দীপঙ্কর বিশ্বাসকে নিয়োগ কমিটি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আর কারো বিরুদ্ধে কোনোই ব্যবস্থা নেয়নি স্থাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
৫ কর্মদিবসের প্রতিবেদন ৫ মাস পর দাখিল হলো
১৬ ফেব্রুয়ারি এবং পরবর্তীতে ৮ মার্চ নিয়োগ কমিটির দুজন সদস্য লিখিতভাবে ঘুষের প্রমাণসহ অভিযোগ দেয়ার পরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে নিশ্চুপ থেকেছে এবং ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছে। পরবর্তীতে গণমাধ্যমে নিয়োগ দুর্নীতির এসব অভিযোগের গুরুতর ঘটনার বিষয়ে বিস্তারিত খবর প্রকাশ এবং টিআইবির বিবৃতিতে তদন্ত দাবির পর সকল মহলে যখন তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়, সেই পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বাধ্য হয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে। গত ১৩ এপ্রিল স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নাজমুল হক খানকে প্রধান করে চার সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিকে ৫ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছিলো। কিন্তু ইতিমধ্যে পাঁচ মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করতে পারছিলোনা। সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে এ নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ গত ৩০ আগস্ট প্রকাশিত হয়, “এপিএস ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের দুর্নীতিতে আটকে আছে সরকারের জরুরি নিয়োগ: তদন্ত কমিটি ৫ কর্মদিবসের রিপোর্ট ৫ মাসেও জমা দেয়নি” শিরোনামে প্রতিবেদন।
অনেক গড়িমসির পর তদন্ত কমিটি অবশেষে প্রায় ৫ মাস পর রিপোর্ট দাখিল করলো। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বহুল আলোচিত এ নিয়োগ প্রক্রিয়াটি বাতিল করা হলো। কিন্তু নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কেন নেয়া হচ্ছে না, এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির একজন সদস্যের বক্তব্য চাওয়া হলে তিনি কোনো রকমের মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী তদন্ত প্রতিবেদন যেভাবে দেওয়ার দরকার ছিলো এবং প্রতিবেদনে যে দিকগুলো উঠে আসার প্রয়োজন ছিলো সেগুলো উপস্থাপন করা যায়নি। প্রতিবেদনে কিছু বিষয়ে অষ্পষ্টতা রাখা হয়েছে ইচ্ছে করেই। তিনি বলেন, যেটুকু প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে এটিই দেয়া যাচ্ছিলো না। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হওয়ায় এবং সরাসরি নিয়োগ কমিটির সদস্যরা লিখিতভাবে অভিযোগ করায় অনেকটা বাধ্য হয়েই তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করেছে। তা নাহলে এ প্রতিবেদন কখনো আলোর মুখ দেখতো না।
ঘুষ লেনদেন, নিয়োগ দুর্নীতি-জালিয়াতিতে জড়িত যারা
মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট ৮৮৯ জন ও মেডিকেল টেকনিশিয়ান ১৮০০ জন নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি হয় ২৯ জুন, ২০২০। তখন থেকেই এ নিয়োগকে কেন্দ্র করে সিন্ডিকেটে গড়ে উঠে। ওই সময় নিয়োগ কমিটির সদস্যসচিব ছিলেন অধিদফতরের তখনকার উপপরিচালক (প্রশাসন) আ ফ ম আখতার হোসেন। যিনি চাকরিজীবনে বরাবরই একজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হিসেবে চিহ্নিত। তার সঙ্গে যুক্ত হন নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত পরিচালক (প্রশাসন) ও নিয়োগ কমিটির সভাপতি ডা. শেখ মোহাম্মদ হাসান ইমাম। এই দু’জনই মূলত ঘুষ লেনদেন, প্রশ্ন ফাঁস এবং লিখিত পরীক্ষার খাতা পরিবর্তনের মতো জাল-জালিয়াতি, অপকর্মে নেতৃত্ব দেন। এরা তাদের অপকর্মের সহযোগী হিসেবে অন্যদের সংগঠিত করেন। তবে নেপথ্য থেকে এই পুরো সিন্ডিকেটের সকল অপকর্মে গডফাদারের ভূমিকা পালন করেন এপিএস ড. আরিফুর রহমান সেখ। তিনিই মূলতঃ এই পুরো নিয়োগকে কেন্দ্র করে প্রশ্নফাঁস ও খাতা পরিবর্তনের মতো নানা রকমের মহা দুর্নীতি-জালিয়াতির ছক আঁকেন। সেইসব ছক বাস্তবায়ন করেন পরিচালক হাসান ইমাম, আখতার হোসেন, ফারুক হাসানসহ অন্যরা। এসবের মধ্যে উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক এমবিডিসি ও লাইন ডাইরেক্টর টিবি-লেপ্রোসি ডা. সামিউল ইসলাম সাদী। ডা. সাদী এসব অপকর্মে অনেক আগে থেকেই সিদ্ধহস্থ। বর্তমান সময়ে তিনি এপিএস আরিফের নানা অপকর্ম-দুর্নীতির সহচর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। ডা. সাদীর উত্থান ঘটে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সময়। ওই সময় পরিচালক (হাসপাতাল) পদে থাকাকালে ব্যাপক দুর্নীতি, লুটপাট, কেলেঙ্ককারির জন্ম দেন ডা. সাদী। গত বছর ১৪৫ জন মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট সরাসরি নিয়োগে ঘুষ লেনদেনের যে কেলেঙ্ককারি হয় তাতে ডা সাদীর একারই ছিলো ৬০ জন, একথা সাদী নিজেই গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছেন। কোটি কোটি টাকা ঘুষ লেনদেনের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে বিরোধের এক পর্যায়ে উপপরিচালক আ ফ ম আখতার হোসেনকে অধিদফতর থেকে আউট করে দেন এপিএস আরিফ এবং পরিচালক ডা. হাসান ইমাম। এরপর এই নিয়োগকে কেন্দ্র করে এপিএস আরিফ, ডা. হাসান ইমাম, ডা সাদী সিন্ডিকেট আরো ব্যাপকহারে ঘুষ লেনদেনে জড়িয়ে পড়েন। এরা দুদক কর্তৃক চিহ্নিত শীর্ষ দুর্নীতিবাজ প্রশাসনিক কর্মকর্তা ফারুক হাসানের নেতৃত্বে সারা দেশ থেকে নতুন করে ঘুষ লেনদেনের নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দেন। প্রতিটি নিয়োগে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেয়া হয়। অবশ্য, আখতার হোসেন আউট হওয়ার পর ঘুষের রেট আরো বেড়ে যায়। প্রশাসনিক কর্মকর্তা ফারুক হাসান, পরিচালক (প্রশাসন) এর পিএ আহসান সাইয়েদ এরশাদ, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল থেকে দুর্নীতির দায়ে বহিষ্কৃত প্রশাসনিক কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন, ডিজি অফিসের কম্পিউটার অপারেটর সোহেল, পরিচালক (এমবিডিসি) এর দফতরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল মমিন শেখ- এই চক্রটি ডিজি অফিসে বসে অতিদ্রুত সারাদেশে তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করে। এখান থেকে সর্বত্র চাকরিপ্রার্থীদের কাছে ম্যাসেজ পাঠিয়ে দেয়া হয় যে, সাবেক উপপরিচালক আ ফ ম আখতার হোসেনের তৈরিকৃত তালিকা বাতিল। নতুন করে গোপন তালিকায় নাম লেখাতে হবে। এই তালিকায় নাম উঠাতে না পারলে চাকরি হবে না। লিখিত পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেলেও মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেয়া হবে। সকল লেনদেনের অর্থ গিয়ে জমা হয় এপিএস আরিফের ফান্ডে। যেখানে যা কিছু খরচ করা দরকার, ফান্ড থেকে তিনিই করছিলেন। কিন্তু গোল বেঁধে যায় নিয়োগ কমিটির দু’জন সদস্যকে ম্যানেজ করতে না পারায়। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শারমিন আক্তার জাহান লিখিত অভিযোগ করার পরও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ক্ষমতাবলে এমন গুরুতর অভিযোগকে পাত্তা দিচ্ছিলেন না এপিএস আরিফ। নতুন করে সমস্যা দেখা দেয় উপপরিচালক ও নিয়োগ কমিটির সদস্যসচিব পদে নতুন নিয়োগ পাওয়া ডা. মো আবুল হাশেম শেখকে নিয়ে। কোনোভাবেই তাকে ম্যানেজ করা যাচ্ছিলো না। এপিএস আরিফ নিজে ডা. মো আবুল হাশেম শেখকে কোটি টাকা ঘুষের অফার এবং পরিচালক (প্রশাসন) পদে পদোন্নতির অফার দেন। কিন্তু ফল দেখা দেয় উল্টো। আবুল হাশেম শেখ লিখিতভাবে এই অফরের কথা উল্লেখ করে সচিব বরাবর অভিযোগ দায়ের করেন।
হাজার হাজার চাকরি প্রার্থীর আর্থিক ও মানসিক ক্ষতির দায় কে নেবে?
মেডিকেল টেকনোলোজিস্টের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ১২ ডিসেম্বর, ২০২০ইং। মেডিকেল টেকনিশিয়ানের লিখিত পরীক্ষা হয় ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর। রাজধানীর ১৩টি কেন্দ্রে এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। মোট ৭২ হাজার ৬১৫ জন চাকরিপ্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের পরবর্তীতে মৌখিক পরীক্ষার কার্যক্রমও চলছিলো। লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে গিয়ে এসব বেকার চাকরিপ্রার্থীর প্রত্যেকের অর্থ খরচ হয়েছে। তাছাড়া মাসের পর মাস এই নিয়োগ প্রক্রিয়া ঝুলে থাকার কারণে এরা মানসিক টেনশনেও ভুগেছে। এখন পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল হবার কারণে তাদেরকে আবার নতুন করে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এদের এই ক্ষতির দায় কে নেবে?
তাছাড়া সরকারেরও অনেক ক্ষতি হচ্ছে। একেতো নিয়োগ প্রক্রিয়া যথসময়ে সম্পন্ন না হওয়ার কারণে সরকারের স্বাস্থ্যসেবা বিঘিœত হয়েছে। অন্যদিকে এখন নতুন করে আবার নিয়োগ পরীক্ষা নিতে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হবে।
দুর্নীতিবাজদের শান্তি দিতে হবে: টিআইবি
স্বাস্থ্য অধিদফতরের জনবল নিয়োগে ব্যাপক ঘুষ লেনদেন ও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশের প্রায় ৬ মাস পর, ‘খাতায় অস্পষ্টতা পাওয়া গেছে’ এই কারণ দেখিয়ে তা বাতিল করা হয়েছে। এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। গতকাল বুধবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে টিআইবি উদ্বেগ প্রকাশ করে। বিজ্ঞপ্তিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্ত এবং ঘুষ লেনদেন ও অনিয়ম-দুর্নীতির জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানানো হয়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানকে উদ্ধৃত করে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে শুধু ‘খাতায় অস্পষ্টতা পাওয়া গেছে’ উল্লেখ করায়, প্রকৃতপক্ষে এই ঘটনায় আদৌ দুর্নীতি হয়েছে কি না, কিংবা হয়ে থাকলে তাদের পরিচয় এবং কীভাবে জবাবদিহি নিশ্চিত করা হবে, তা অমীমাংসিত থেকে গেছে। এ বিষয়ে ড. জামান বলেছেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত যে প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করা হলো, সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে পদস্থ সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোটি টাকা ঘুষ প্রস্তাব করার অভিযোগ ছিল। এই অভিযোগের সত্যতা যাচাই করা হয়েছে কি না বা জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নগুলো অবান্তর নয়। বরং আমরা মনে করি, দুর্নীতির যে ভয়াবহ বিস্তারের ইঙ্গিত সেই প্রতিবেদনে ছিল, তার প্রেক্ষিতে গ্রহণযোগ্য তদন্তের ভিত্তিতে দ্রুত কঠোর পদক্ষেপই প্রত্যাশিত ছিল। অনিয়মের তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়ায় নিয়োগ বাতিল করে আপাতত বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে এবং কার্যত দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটকেই টিকিয়ে রাখা হলো। পাশাপাশি এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে কথিত ‘উপরমহলের’ যোগসাজশের সন্দেহটাও ঘনীভূত হলো।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে, কেউ স্বাস্থ্য খাতে বড় কোনো দুর্নীতি দেখাতে পারেনি’ এমন সব মন্তব্য করে দায় এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ আর নেই। পক্ষ-বিপক্ষের বিবেচনার ঊর্ধ্ব উঠে প্রতিটি অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত করে, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। বিশেষ করে, এ পর্যন্ত স্বাস্থ্যখাত নিয়ে যত ধরনের অভিযোগ এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর নানামুখী স্বার্থ ও সংশ্লিষ্টতার কথা আলোচিত হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে সামগ্রিক শুদ্ধাভিযান এখন সময়ের দাবি।
(সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ প্রকাশিত)