
shershanews24.com
প্রকাশ : ০৩ অক্টোবর, ২০২১ ১২:৫৩ অপরাহ্নসাপ্তাহিক শীর্ষকাগজের সৌজন্যে: সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর দফতরের পিয়ন, নাম মো. ইদ্রিস। বাড়ি নরসিংদীর পলাশ উপজেলায়। পিয়ন হলেও মন্ত্রণালয়ে অত্যন্ত প্রভাবশালী। কারণ, মন্ত্রীর খাস লোক। এই পিয়ন একা-ই দুস্থ, দরিদ্র, প্রতিবন্ধী প্রভৃতি শত শত অসহায় মানুষের নামে ইস্যু হওয়া চেকের টাকা তুলে নিয়েছেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ থেকে সরকারের অনুদান হিসেবে এই চেকগুলো ইস্যু হয়েছিলো। চেকগুলো ছিলো পূবালী ব্যাংক শান্তিনগর শাখার জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদের একাউন্টের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের এক তদন্তে এই তথ্যগুলো বেরিয়ে এসেছে। হ্যাঁ, অবাক করার মতো ঘটনাই বটে! আরো অবাক করার বিষয় হলো পিয়ন মো. ইদ্রিস জাল স্বাক্ষরের মাধ্যমে ৫২৫ জন ভিন্ন ভিন্ন মানুষের নামে ইস্যু হওয়া ৫২৫টি চেকের টাকা এক দিনেই একই সময়ে তুলেছেন পূবালী ব্যাংকের ওই একাউন্ট থেকে। এই ৫২৫টি চেকের মোট অর্থের পরিমাণ ৪৫ লাখ ৬৮ হাজার। ২০২০ সালের ১ জুন এই চেকগুলোর টাকা তোলা হয়। জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদের নামে পরিচালিত পূবালী ব্যাংক শান্তিনগর শাখার হিসাব নম্বর- ২৯৪০১০২০০০১৪৩।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এর প্রতিবেদনে বলা হয়, “পূবালী ব্যাংক লিমিটেড, শান্তিনগর শাখা হতে বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদের নামে পরিচালিত হিসাব হতে পরিষদ কর্তৃক ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির নামে ইস্যুকৃত ৫২৫টি চেকের অপর পৃষ্ঠায় জাল স্বাক্ষর করতঃ একজন ব্যক্তি কর্তৃক ৪৫.৬৮ লক্ষ টাকা উত্তোলন করে আত্মসাত করা হয়েছে। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ (২০১৫ সালের সংশোধনীসহ) এর ২ (শ) ধারা মোতাবেক ‘জালিয়াতি’ সম্পৃক্ত অপরাধ হিসেবে পরিগণিত।”
হিসাবটির পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ কর্তৃক ইস্যুকৃত এই ৫২৫টি চেকের মধ্যে ৫ হাজার টাকার ৬৮টি, ৭ হাজার টাকার ১টি, ৮ হাজার টাকার ৭টি ও ৯ হাজার টাকার ৪৫৮টি। ০১/০৬/২০২০ তারিখে একই সময়ে এই চেকগুলোর টাকা তোলা হয় এবং টাকাগুলো তোলেন এক ব্যক্তিই মো. ইদ্রিস। জাতীয় পরিচয়পত্রে তার গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর পলাশ থানায় বলে উল্লেখ রয়েছে। পিতার নাম আব্দুল বাতেন। এক ব্যক্তি কীভাবে একই সময়ে একই সঙ্গে এতোগুলো চেকের টাকা তুললেন, যেখানে চেকগুলো প্রত্যেকটিই আলাদা আলাদা ব্যক্তির নামে ইস্যু করা? এর কোনো জবাব দিতে পারছেন না, পূবালী ব্যাংক শান্তিনগর শাখার কর্মকর্তারা। এমনকি চেক ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠান- বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদের কমকর্তারাও এর জবাব দিতে পারছেন না।
ব্যাংক থেকে টাকা তোলার সাধারণ নিয়ম হলো, যার নামে চেক ইস্যু হয়েছে তিনি সংশ্লিষ্ট কাউন্টারে ব্যাংক অফিসারের সামনে নিজের স্বাক্ষর দেবেন চেকের অপর পৃষ্ঠায়। তারপরই চেকের টাকা পরিশোধ করা হবে। প্রত্যেকটি ব্যাংকেই এ নিয়ম চালু আছে। কিন্তু এক্ষেত্রে কীভাবে একই সময়ে একজন ব্যক্তি ব্যাংকের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ৫২৫ জন ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির স্বাক্ষর দিলেন। ব্যাংকও কীভাবে প্রকাশ্যে এমন জালিয়াতির সুযোগ দিলো? বস্তুত পূবালী ব্যাংক, জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যোগসাজশেই এমন জালিয়াতি হয়েছে। শুধু ওই ৫২৫টি চেকের ঘটনাই নয়, এর আগে পরে বরাবর এভাবেই সরকারের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। যে টাকাগুলো সরকার বরাদ্দ দিয়েছিলো প্রতিবন্ধী, দুস্থ, দরিদ্র, অসহায় মানুষদের অনুদান হিসেবে প্রদানের জন্য। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, প্রতিবন্ধী, দুস্থ মানুষদের নামে অর্থ সাহায্যের চেক ইস্যু হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানতেও পারছেন না যে, তাদের নামে সাহায্যের কোনো চেক ইস্যু হয়েছে। জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা এসব চেকের অর্থ আত্মসাত করছেন, যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারাও জড়িত।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদের নামে পরিচালিত পূবালী ব্যাংক শান্তিনগর শাখার- ২৯৪০১০২০০০১৪৩ হিসাব নম্বরটি পরিচালিত হচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদের নির্বাহী সচিব এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) এর স্বাক্ষরে। অর্থাৎ যখন যে কর্মকর্তা এই পদ দুটিতে কর্মরত থাকেন তাদের যৌথ স্বাক্ষরে প্রতিটি চেক ইস্যু হয়। দুস্থ, দরিদ্র, প্রতিবন্ধী, পঙ্গু, অসহায় মানুষদের সাহায্যের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদান করেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী। তিনি এ সংক্রান্ত কমিটির সভাপতি। সাহায্যের নথি চূড়ান্ত অনুমোদনের পর জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ প্রত্যেকের নামে ভিন্ন ভিন্ন চেক ইস্যু করে। যাদের নামে চেক ইস্যু হয় সেই ব্যক্তিদের হাতে চেক হস্তান্তরের দায়িত্বও জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদের। কিন্তু এক্ষেত্রে এতগুলো চেক কীভাবে একসঙ্গে মো. ইদ্রিসের হাতে গেলো, এর পরিষ্কার কোনো জবাব দিতে পারছেন না জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদের কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, “হিসাব খোলার ফরম অনুসারে সরকারি অনুদানের অর্থ জমা ও উত্তোলনের জন্য হিসাবটি খোলা হয়েছে। অর্থাৎ সরকার থেকে বরাদ্দকৃত অনুদানের অর্থ বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদের নির্দেশনায় আলোচ্য হিসাবের মাধ্যমে অনুদানপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অনুকূলে প্রেরণ করা হয়ে থাকে। যেহেতু অনুদানের অর্থ ছাড়করণের জন্য বর্ণিত হিসাবটি খোলা হয়েছে সেহেতু অর্থ ছাড়করণের বিষয়ে অফিস নির্দেশনার কপি (পত্র) ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখায় প্রেরণ করার আবশ্যকতা রয়েছে। কারণ, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদের অর্থ ছাড়ের নির্দেশনা ও তাদের পরিচিতির তথ্য সরবরাহ ব্যতিত অনুদানের অর্থের প্রকৃত সুবিধাভোগী চিহ্নিতকরণের বিষয়টি ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখা কর্তৃক দুরহ মর্মে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু ০১/০৬/২০২০ তারিখে আলোচ্য চেকসমুহের অর্থ উত্তোলনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ কর্তৃক অর্থ উত্তোলনের নির্দেশনা সম্বলিত কোন অফিস নির্দেশনা (ডেবিট ইন্সট্রাকশন), অনুদানপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের তালিকা, তাদের পরিচিতি শান্তিনগর শাখায় সরবরাহ করা হয়নি। অর্থাৎ উল্লিখিত তথ্যাদি ছাড়াই শুধুমাত্র চেক জমা করতঃ অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে চেক জালিয়াতির ও দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় অনুদানের অর্থ সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে মর্মে প্রতীয়মান হয় বিধায় বিষয়টি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক খাতিয়ে দেখার আবশ্যকতা রয়েছে।”
(সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ প্রকাশিত)