বৃহস্পতিবার, ০৭-ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:৫১ পূর্বাহ্ন
সমাধান খুঁজছে বাংলাদেশ 

রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে মিয়ানমারের ফাঁদ

shershanews24.com

প্রকাশ : ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০৪:১৬ অপরাহ্ন

সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজের সৌজন্যে: রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট নিয়ে কি বাংলাদেশের সামনে ফাঁদ পেতেছে মিয়ানমার? আর সে ফাঁদ কী তথাকথিত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা আর তা ভেস্তে দেয়া? এমন প্রশ্ন কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক তো বটেই সাধারণ মানুষেরও। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে যাচ্ছে না, নাগরিকত্বের বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা যাবে না এমন কথা সরাসরিই জানিয়ে দিয়েছে রোহিঙ্গারা। এমন অবস্থায় রোহিঙ্গা সংকট কোন দিকে গড়ায় সেটি নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না কেউ। রোহিঙ্গা সংকটের দিকে সারাবিশে^র চোখ থাকলেও ধীরে ধীরে সেই গুরুত্ব হারাতে বসেছে, বলা যায় যে রোহিঙ্গা সংকট সারা পৃথিবীতেই হয়ে উঠেছিল আলোচনার বিষয়। অথচ তা এখন অনেকটা বাংলাদেশ আর মিয়ানমারের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে পরিণত হতে চলেছে। জাতিসংঘ, ইইউসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও রাষ্ট্রগুলো এ ক্ষেত্রে পালন করছে দর্শকের ভূমিকা, কেউ কেউ বড়জোর ত্রাণ সহায়তা প্রদানকারীর ভূমিকায় আছে। সব মিলিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশের উদ্যোগ বা চেষ্টা কি যথেষ্ট ছিল? বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং কূটনীতিকরা কী যথেষ্ট দক্ষতা দেখাতে পেরেছেন? নেপিডোকে বিশ^াস করে কি ভুল করেছিল ঢাকা? অনেকেরই পরামর্শ, বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ করতে হবে। নিজেদের ভুলভ্রান্তিকে পেছনে ফেলে সমস্যার সমাধানে প্রকৃত পথ খুঁজতে হবে। আর এজন্য বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল রাষ্ট্রগুলোকে এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। 
দ্বিতীয় দফায়ও ব্যর্থ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া
গত ২২ আগস্ট ছিল রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কার্যক্রম শুরু করার দিন। পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল বাংলাদেশ কিন্তু শেষ বেলায় এসে জানা গেল রোহিঙ্গারা এ অবস্থায় ফিরে যেতে রাজি নয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার বিষয়টি এখন অনেকটাই নির্ভর করছে রোহিঙ্গাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য ৩ হাজার ৫৪০ জনের একটি তালিকা বাংলাদেশকে দিয়েছিল মিয়ানমার। এরমধ্যে শালবাগান শিবিরের বাসিন্দাই ৩ হাজার ৯১জন। তিন দিন ধরে আড়াই হাজার রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার নেয়া হয়, তারা কেউই নিঃশর্তভাবে মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি হয়নি। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর সব আয়োজনই করা ছিল। নাফ নদীর কেরুনতলী ঘাট এবং নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তে দু’টি প্রত্যাবাসন কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। ক্যাম্প থেকে ওই কেন্দ্র পর্যন্ত নেয়ার জন্য প্রস্তুত রাখা ছিল গাড়ি। নদী পারাপারের জন্য রাখা হয়েছিল ট্রলারও। কিন্তু কোন রোহিঙ্গা পরিবারই যেতে রাজি হয়নি। এর আগে ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর প্রথম দফায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর কথা ছিল। তবে একটি রোহিঙ্গা পরিবার বা একজন রোহিঙ্গাও সেদিন প্রত্যাবাসনের জন্য পাওয়া যায়নি। উল্টো সেদিন রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছিল। তাদের বিক্ষোভে ওই উদ্যোগ ভ-ুল হয়ে যায়। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার যদিও রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর কাজ শুরু করা যায়নি তারপরও এবারের পরিস্থিতিতে প্রথম দফার চে’ কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। কেন না প্রথমবার কোন রোহিঙ্গা সাক্ষাৎকার দিতেই আসেনি, এবার তালিকায় থাকা প্রায় সব পরিবারই সাক্ষাৎকার দিয়েছে, যাওয়ার ব্যাপারে তারা সরাসরি না করেনি; শর্ত দিয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো এই শর্ত পূরণ করবে কে আর কখন? তবে প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ায় খুশি রোহিঙ্গারা। সেখানে গিয়ে আবারও মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার আশংকা থেকে বেঁচেছে তারা। ২২ আগস্টের পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন স্থানে দল বেঁধে তারা প্রত্যাবাসন না হওয়ায় আনন্দ প্রকাশ করে। অনেকে সাংবাদিকদের দেখে বিজয় সূচক ‘ভি’ চিহ্ন দেখান। তারা প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়াকে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ও থাকার সুফল বলে মনে করছে। 
পাঁচদফায় অনড় রোহিঙ্গারা
পর্যবক্ষেকরা মনে করেন, রোহিঙ্গারা দিন দিন সংগঠিত হচ্ছে। বাংলাদেশে তারা আশ্রয় নিয়েছিল বিক্ষিপ্তভাবে জীবন বাঁচাতে। যে যেভাবে পেরেছে বাংলাদেশে এসে ঠাঁই নিয়েছে। কিন্তু এখন তাদের কাজ-কর্ম খুবই সংগঠিত। এমনকি তাদের দর কষাকষির সক্ষমতাও তৈরি হয়েছে। মিয়ানমারে ফেরত যেতে পাঁচ দফা দাবি দিয়েছে রোহিঙ্গারা। তাদের দাবিগুলো হচ্ছে:
১. রোহিঙ্গারা আরাকানের (রাখাইন) স্থায়ী বাসিন্দা। সে কারণে রোহিঙ্গাদের স্থানীয় স্বীকৃতি দিয়ে সংসদে (মিয়ানমারের) আইন পাস করতে হবে।
২. আরাকানে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও পরিচয়পত্র দিতে হবে।
৩. রোহিঙ্গাদের নিজ গ্রামে ফিরিয়ে নিতে হবে। কেড়ে নেয়া জমিজমা যথাযথ ক্ষতিপূরণসহ ফেরত দিতে হবে। 
৪. আরাকানে রোহিঙ্গাদের জীবন ও সম্পদ সুরক্ষার জন্য রোহিঙ্গা পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করতে হবে।
৫. মিয়ানমারের স্থানীয় আদালতে না করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অপরাধীদের বিচার করতে হবে।
রোহিঙ্গা শরণার্থী নেতাদের দাবি, রোহিঙ্গারা এই পাঁচদফা দাবিকে নিজেদের দাবি মনে করে এবং এর প্রতি একাত্ম। এই দাবিগুলোর ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের মধ্যে জনসমর্থন তৈরি ও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে রোহিঙ্গাদের নানা সংগঠন। তারা ইংরেজি ও বার্মিজ ভাষায় লেখা লিফলেট বিলি করে এবং ছোট ছোট আলোচনা সভার মাধ্যমে এসব দাবির প্রতি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঐক্যবদ্ধ করে তুলছে। 
তবে এসব দাবির কোনটিই বাংলাদেশের পক্ষে পূরণ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গারা যেসব দাবি করেছে সেটা মানতে বাংলাদেশ বাধ্য নয়। তিনি বলেন, তাদের দাবি নিজ দেশে গিয়েই অর্জন করতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের দাবির কাছে জিম্মি হয়ে থাকতে পারে না। 
তাদের এত আরাম থাকবে না: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
অনেকেই বলছেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে যে জীবন কাটিয়েছে শরণার্থী হলেও বাংলাদেশে তারা তারচে’ অনেক ভাল আছে। এজন্যই তারা নিজ দেশে ফিরে যেতে চায় না। মিয়ানমারে তাদের জীবনের নিরাপত্তা আর জীবিকার নিশ্চয়তা ছিল না, এখানে তাদের এ দুটোই বেশ ভালভাবে আছে। বাংলাদেশ ছাড়া বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা রোহিঙ্গাদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করছে। তাদের নিরাপত্তায় বাংলাদেশকে সবসময়ই সতর্ক, শুধু সতর্কই নয় বলা যায় তটস্থ থাকতে হয়। কেন না, রোহিঙ্গাদের বিষয়টি একটি আন্তর্জাতিক বিষয়। কোন কারণে যদি কোন রোহিঙ্গার নিরাপত্তা বিঘিœত হয় তাহলে তা আন্তর্জাতিক অঙ্গণে বাংলাদেশের সুনামও ক্ষুণœ করবে। সবমিলিয়ে মোটামুটি নিশ্চিন্ত ও স্বস্তিকর জীবনই কাটাচ্ছেন রোহিঙ্গারা। ক্যাম্পের জীবন হলেও নানা কারণে পৃথিবীর অনেক দেশের শরণার্থীদের চে’ অনেক ভাল আছে বাংলাদেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। তবে এ সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন বলেছেন, ভবিষ্যতে তাদের অতো আরাম থাকবে না। এখন তো অনেকে সাহায্য দেয়। বেশি দিন থাকলে সেই টাকা থাকবে না। বাংলাদেশও নিজস্ব তহবিল থেকে অনেক টাকা খরচ করেছে। এত টাকা না থাকলে সমস্যা হয়ে যাবে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের নিজেদের ভবিষ্যতের জন্যই নিজ দেশে ফিরে যাওয়া উচিত। তিনি সাফ জানিয়ে দেন রোহিঙ্গাদের আর বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে পারবে না বাংলাদেশ। প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ার দায় মিয়ানমারের উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন বলেন, বাংলাদেশ চেয়েছিল মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফেরানোর উদ্যোগ নিক, রোহিঙ্গা মাঝিদের একটি দলকে ঘুরিয়ে এনে তাদের বাসস্থান ও নিরাপত্তায় কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা তারা দেখে আসুক। মিয়ানমার তা করেনি। তারা তাদের নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে। পরে সিলেটে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, রোহিঙ্গারা যতদিন বাংলাদেশের ভূখ-ে আছে, অতিথি হিসেবে তাদেরকে বাংলাদেশের আইন-কানুন মেনে চলতে হবে, এর ব্যত্যয় ঘটলে তাদের শাস্তি পেতে হবে।
অবশ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ‘আরামে’ থাকা কথাটার সমালোচনা করছেন অনেকে। রোহিঙ্গা শিবিরে কাজ করা একাধিক উন্নয়ন কর্মী বলছেন, লাইন ধরে ত্রাণ নিয়ে জীবন কাটানোর মধ্যে কোন আরাম নেই। রোহিঙ্গারা জানে না তাদের আগামী দিনগুলো কেমন কাটবে? তাদের শিশুদের কোন ভবিষ্যত নেই। রোহিঙ্গা পরিবারগুলো বড়। সেসব পরিবার আরো বড় হচ্ছে। তিনজন থাকা যায় না এমন জায়গায় থাকছে সাত-আটজন। তাদের কোন ব্যক্তিগত জীবন নেই। রোহিঙ্গাদের অনেকের মধ্যেই এ বিষয়গুলো কাজ করে, তাদের অনেক মানসিক ক্ষতি হচ্ছে। 
কোন কোন বিশ্লেষক ও মানবাধিকার কর্মী বলছেন, রোহিঙ্গাদের অনেকেই নিজ দেশে যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিলেন, বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরের জীবনকে তারা বাস্তবতা বলে মেনে নিলেও এই অবস্থাকেই জীবনের শেষ মানতে রাজি নন তারা। নিজ দেশ আর ভিটেমাটি তাদের টানে। তারা আশা করেন, একদিন না একদিন তারা স্বভূমে ফিরতে পারবেন, তবে সে জীবন যাতে বন্দি জীবন না হয় সেজন্যই নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে যতদূর সম্ভব অধিকার আদায় করে বা নিশ্চিত করে তারা দেশে ফিরতে চান। 
অভিযোগের তীর এনজিওগুলোর দিকে
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ দেশে ফিরে যেতে না চাওয়ার পেছনে দেশি-বিদেশি নানা তৎপরতার কথাও জোরেসোরে উচ্চারিত হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ওপর ভর করে ওই এলাকায় গড়ে উঠছে অনেক এনজিও। তারা রোহিঙ্গাদের শিক্ষা, দীক্ষা, সংস্কৃতিসহ নানাদিকে উন্নয়নের কথা বলে বিদেশি তহবিল পাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের জীবন মান উন্নয়নেও তহবিল পাচ্ছেন তারা। রোহিঙ্গারা চলে গেলে তাদের এসব কাজ করার সুযোগ থাকবে না তাই অনেক এনজিও চায় না রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যাক। এই এনজিওগুলোই রোহিঙ্গাদের নানাভাবে প্ররোচিত করছে যাতে তারা নিজ দেশে ফিরে না যায়, এমন অভিযোগ করছে কেউ কেউ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, প্রত্যাবাসনে যারা বিরোধিতা করছে তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তারা প্রচারণা চালাচ্ছে, ইংরেজিতে লিফলেট তৈরি করে দিচ্ছে। মন্ত্রী জানান, যারা রোহিঙ্গাদের না যাওয়ার জন্য লিফলেট ছড়াচ্ছে, প্রচারণা চালাচ্ছে তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। ২৯ আগস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, যারা ননগভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশন আছে কিংবা অন্য সব প্রতিষ্ঠান আছে, যারা তাদের নিয়মের বাইরে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত কিংবা অন্য কিছুতে সম্পৃক্ত তাদের চিহ্নিত করা হবে,  তারা যদি তাদের শর্তের বাইরে কাজ করে তাহলে তাদের শাস্তি দেয়া হবে, তাদেরকে ‘উইথড্র’ করা হবে। তিনি বলেন, এত বড় শো ডাউন হলো, লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করা হলো। কারও জাতীয় আইডি নাই কিন্তু সবার হাতে সেলফোন আসলো কোথা থেকে? এগুলো বিভিন্ন এনজিও সাপ্লাই দিয়েছে, বড় বড় বিলবোর্ড বানিয়েছে, ডিজিটাল ব্যানার দিয়েছে, লিফলেট বানিয়েছে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের হাতে দা-কুড়াল দেয়া হচ্ছে। যারা দা-কুড়াল দিয়েছে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভায়ও রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বিভিন্ন এনজিওর অপতৎপরতা নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়।
রোহিঙ্গা শিবিরে স্মরণকালের বৃহত্তম সমাবেশ
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার ২ বছর পূর্তিতে ২৫ আগস্ট কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং মধুরছড়া আশ্রয় শিবিরের তিনটি পাহাড় ও মাঠে জড়ো হয়েছিলো লাখো রোহিঙ্গা। ওই সমাবেশে রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, তাদেরকে আগে নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। এরপর বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা একত্রে মিয়ানমারে ফিরে যাবে। তারা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, কোনো রোহিঙ্গাকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বা জোর করে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করা হলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে পারে। তারা বলেন, যদি মিয়ানমারে ফিরে যেতে হয় তাহলে তারা একসাথে যাবেন। সমাবেশে উপস্থিত রোহিঙ্গারা দাঁড়িয়ে এই কথার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন। সমাবেশ থেকে ২০১২ সালে ১ লাখ ২৮ হাজার রোহিঙ্গাকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে আশ্রয় শিবিরে রাখা হয়েছে জানিয়ে তাদেরকে নিজ নিজ বাসস্থানে ফিরিয়ে নেয়ার দাবি জানানো হয়।
রাখাইনে গণহত্যা, ধর্ষণসহ বর্বর নির্যাতনের বিচার ও এর সাথে জড়িত সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী মগদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের দাবিতে এই মহাসমাবেশের আয়োজন করেছিল রোহিঙ্গারা। ওইদিন সকাল থেকেই মিছিল নিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা সমাবেশস্থলে আসতে থাকেন। তারা নানা শ্লোগান দিতে থাকেন। সমাবেশে রোহিঙ্গা নেতা সৈয়দ উল্লাহ বলেন, দুই বছর ধরে তারা পরবাস জীবন যাপন করছেন। নিজ ভিটেমাটিতে এখনো ফিরতে পারেননি। তারা বলেন, বিশ্বের নেতারা রোহিঙ্গাদের প্রতি শুধু সহানুভুতি দেখায় কিন্তু তাদেরকে নিজ দেশে ফেরানোর মতো কার্যকর কোন পদক্ষেপ কেউ নেয়নি। একে মিয়ানমারের পাশাপাশি বিশ্ববাসীর ব্যর্থতা বলেও উল্লেখ করেন রোহিঙ্গা নেতারা।
রোহিঙ্গা বিতাড়ন যেভাবে
মিয়ানমারের অভিযোগ, ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট রোহিঙ্গাদের একটি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা) মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের ওপর হামলা চালায়। মিয়ানমার সরকারের অভিযোগ, উত্তর রাখাইনে ২০টির বেশি পুলিশ ক্যাম্পে ভোর রাতে একযোগে হামলা চালায় আরসা। সে হামলায় ওই বাহিনীর ১২জন সদস্য নিহত হয়। ২৫ আগস্ট কয়েক হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া এবং টেকনাফে এসে আশ্রয় নেয়। তারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যাকা- ও অত্যাচারের কথা জানায়। ২৬ আগস্ট ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ঢাকা। বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টাকালে বেশ কিছু রোহিঙ্গাকে আটক করে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি। তবে সীমান্তের ওপারে রোহিঙ্গারা জড়ো হতে থাকে। বাংলাদেশে ঢোকা ছাড়া তাদের সামনে আর কোন উপায় ছিল না। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ তাদেরকে আশ্রয় দিতে শুরু করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবিক কারণে তাদের ঠাঁই দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। 
২০১৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াং হি লি রাখাইনের পরিস্থিতি ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেন। তিনি মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সূ চিরও সমালোচনা করেন। ৫ সেপ্টেম্বর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে টেলিফোনে কথা বলেন সু চির সাথে। সু চির দপ্তর থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে রাখাইন অঞ্চলের পরিস্থিতিকে বিকৃতভাবে তুলে ধরা হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়। একই দিন ঢাকা সফরে আসেন ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি, ঢাকা আসার আগে তিনি মিয়ানমারও সফর করেন। ২০১৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যানতনিও গুতেরেস নিরাপত্তা পরিষদকে চিঠি লেখেন, চিঠিতে তিনি রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে নিজের উদ্বেগের কথা জানান। কক্সবাজার, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয় শিবিরে বর্তমানে ১১ লাখ নিবন্ধিত রোহিঙ্গা আছে। তবে জন্ম নেয়ার কারণে এ সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। 
পিঠ বাঁচাতে মিয়ানমারের ফাঁদ
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে প্রত্যাবাসন চুক্তি হয়। ওই চুক্তিতে প্রত্যাবাসনের উপায় নিয়ে বিস্তারিত বলা আছে। সাবেক কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মিয়ানমার আসলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের সাথে একধরণের প্রতারণামূলক আচরণ করেছে। তারা বলেন, মিয়ানমার এ সমস্যার ক্ষেত্রে দ্বৈত আচরণ করছে। তারা বিষয়টিকে মোটেই গুরুত্ব দেয় না কিন্তু যখনই আন্তর্জাতিক কোন চাপ তৈরি হয় বা তৈরির মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তখনই তারা এ বিষয়ে কিছুটা তৎপরতা শুরু করে। তারা মনে করেন, সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন বসবে। ওই অধিবেশনে রোহিঙ্গা সংকট এবং শরণার্থীদের নিয়ে চাপের মুখে পড়তে পারে মিয়ানমার। আর তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসনে নিজেদের সদিচ্ছার বিষয়টি দেখাতেই প্রত্যাবাসনের এমন উদ্যোগ নিয়েছে মিয়ানমার। মিয়ানমার হয়তো বৈশি^ক এ ফোরামে ধারণা দিতে পারে যে, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তারা সব ধরণের চেষ্টাই করছে কিন্তু রোহিঙ্গারা ফিরতে অনাগ্রহী। তারা সতর্ক করে দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ যাতে মিয়ানমারের ফাঁদে আটকে না যায় সে জন্য ঢাকার কূটনীতিকদের সতর্কতার সাথে পা ফেলতে হবে। আবেগ দিয়ে বা বিশ^ সম্প্রদায়ের সহানুভূতি কুড়ানোর চেষ্টা করে লাভ নেই, কূটনীতিকে কূটনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করতে হবে। 
মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র, নতুন উদ্যোগ চীনের
রোহিঙ্গা ইস্যুতে তার দেশ বাংলাদেশের পাশে থাকবে বলে জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত আমেরিকান রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার। ২৪ আগস্ট কুড়িগ্রামে তিনি এ কথা বলেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, এ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশে আছে ও থাকবে। তিনি বলেন, সম্মান ও নিরাপত্তার সাথে রোহিঙ্গারা যাতে নিজ দেশে ফিরতে পারে সেজন্য আমেরিকা ও জাতিসংঘের অন্যান্য রাষ্ট্র মিলে যা যা করা দরকার তার সবই করবে। তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে। চাপের উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রধানসহ নিরাপত্তা বাহিনীর অনেকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
২২ আগস্টের উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার পর প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে আলোচনার উদ্যোগ নেয়ার জন্য আগ্রহ দেখিয়েছে চীন। ২৮ আগস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পাঠানো এক নোট ভারবালে ওই প্রস্তাব পাঠায় চীন। দু’দেশের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনায় আগ্রহী চীন। বাংলাদেশ এ আলোচনায় ইতিবাচক। মিয়ানমার সম্মতি দিলে ঠিক হবে বৈঠকের স্থান ও তারিখ।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীনের গুরুত্ব নিয়ে বাংলাদেশ সবসময়ই ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। এ বছরের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফরকালে এ নিয়ে কথা বলেছেন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ও প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং এর সাথে। তারা দু’জনই আশ^াস দিয়েছিলেন সংকট সমাধানে মিয়ানমারকে রাজি করানোর উদ্যোগ নেয়ার ব্যাপারে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগদান আর চীনা নেতাদের আশ^াসের পর এবার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে একটু বেশিই আশাবাদী ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সে আশা পূরণ হয়নি, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো শুরু করা যায়নি। চীনের নয়া উদ্যোগ মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের দাবির ব্যাপারে আর তাদের ফেরানোর ব্যাপারে কতটা নমনীয় করাতে পারে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
কি করবে বাংলাদেশ?
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে খাবিখাই অবস্থায় বাংলাদেশ। নানাভাবে এ সংকট সমাধানে চেষ্টা চালাচ্ছে ঢাকা। দিচ্ছে বিকল্প অনেক প্রস্তাব। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত দুই দেশের যৌথ কমিশনের বৈঠকে রোহিঙ্গা মাঝিদের (গোত্রপতি) মধ্যে শ’খানেককে রাখাইনে নেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। তারা সেখানে গিয়ে দেখে এসে বলবে তাদের জন্য কেমন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, কেমন নিরাপত্তা নেয়া হয়েছে। তারা দেখে সন্তুষ্ট হয়ে অন্যদের যেতে উৎসাহিত করতে পারতো। একই ধরণের অভিমত এসেছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির বৈঠক থেকেও। ২২ আগস্ট কমিটির এক বৈঠকে সুপারিশ করে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে প্রথমে তাদের মাঝিদের রাখাইনের পরিস্থিতি দেখিয়ে আনতে হবে। এতে রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যেতে উৎসাহী হবে। কমিটির সভাপতি ফারুক খান বলেন, মানবিক কারণে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছিল। তাদেরকে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কোন ‘বার্গেনিং এজেন্সি’ নয়। 
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়াটা দুঃখজনক। দুই দফায় প্রত্যাবাসন শুরুর উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশ আরো সতর্ক হয়ে পদক্ষেপ নেবে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পরবর্তীতে চিন্তা-ভাবনা করা হবে তাদের কীভাবে পাঠানো যায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের আশা ছিল স্বল্প আকারে হলেও প্রত্যাবাসন শুরু হবে, তা হয়নি, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রস্তুতির কোন ঘাটতি ছিল না। সমস্যাটা তৈরি করছে মিয়ানমার। রোহিঙ্গারা তাদের দেশকে বিশ^াস করে না। মিয়ানমারকে তাদের নাগরিকদের বিশ্বাসসযোগ্যতা অর্জন করতে হবে। মিয়ানমার অবিশ্বাসের দেয়াল ভাঙতে পারলেই রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যাবে, স্বস্তিকর পরিবেশ ফিরে আসবে বাংলাদেশেও।
(সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ প্রকাশিত)