shershanews24.com
অকাস চুক্তি: এশিয়ায় শক্তির ভারসাম্য পাল্টে যাচ্ছে?
সোমবার, ০৪ অক্টোবর ২০২১ ০১:০৭ অপরাহ্ন
shershanews24.com

shershanews24.com

সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজের সৌজন্যে: সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটেছিল, কিন্তু এখন আবার যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিশ্বকে বিভক্ত করছে এবং যেকারণে স্নায়ু যুদ্ধ নিয়ে শংকিত হয়েছেন খোদ জাতিসংঘ মহাসচিবও। বিপজ্জনক চেহারা নিচ্ছে চীন-মার্কিন বৈরিতা, পরিণতি কী হতে পারে তা নিয়ে বিশ্ব উৎকণ্ঠায় নিপতিত হয়েছে।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ তারিখে Australia, United Kingdom, United States সম্পাদিত AUKUS নিরাপত্তা চুক্তি বৈরীতার আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে। বৃটেনের বিরুদ্ধে (আমেরিকার) স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সবকিছু দিয়ে যে ফ্রান্স আমেরিকাকে সাহায্য করেছিল তার প্রতি এমন আচরন করেছে যাতে ফরাসিরা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছে। 
কিন্তু সাহায্য গ্রহণকারী আমেরিকার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। কারণ বিশ্বব্যাপি তার আধিপত্য বজায় রাখার জন্য ফ্রান্সের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে, এ রাজনীতি আমেরিকা করে না। কারণ আমেরিকার মূল ধারার নাগরিকেরা বৃটেন থেকেই এসেছে, যেমন সেটেল হয়েছে অষ্ট্রেলিয়ায়।
১৮৫৯ সালে প্রকাশিত চার্লস ডিকেন্সের লেখা কালজয়ী একটি উপন্যাসের নাম ‘এ টেল অব টু সিটিজ’ ( A Tales of Two Cities)। উপন্যাসে ফরাসি বিপ্লব শুরুর সময়ে ফ্রান্সের চাষিদের দুর্দশার কথা, বিপ্লবের প্রথম বছরগুলোয় বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ড এবং একই সময়ে লন্ডনের জীবনের সঙ্গে ফ্রান্সের নানা পার্থক্য এবং দ্বন্দ্বের কথা তুলে ধরে লন্ডন ও প্যারিস শহরকে চিত্রায়িত করা হয়েছে। 
দুটি দেশের মানুষের কথা নিয়ে লেখা উপন্যাসটি সাড়া জাগিয়েছিল। বিশ্বব্যাপী বইটির প্রায় ২০ কোটি কপি বিক্রির হিসাব পাওয়া যায়। সারা পৃথিবীতে অনুবাদ হয়েছে পঞ্চাশেরও বেশি ভাষায়।
যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনের সঙ্গে গত সপ্তাহে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন নির্মাণ বিষয়ক চুক্তি স্বাক্ষর করে অস্ট্রেলিয়া। এতে আগে থেকে ফ্রান্সের সঙ্গে করা ৪০০০ কোটি ডলারের সাবমেরিন বিষয়ক চুক্তি বাতিল করে অস্ট্রেলিয়া। ফলে প্রচণ্ড ক্ষোভ দেখা দিয়েছে ফ্রান্সে। 
এসব নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা জাতিসংঘে বিশ্ব নেতাদের সম্মেলনের বাইরে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে আলোচনা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেন যখন আঘাত হেনেছে ফ্রান্সকে তখন সেপ্টেম্বর ২০, ২০২১ (সোমবার) নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সাবমেরিন চুক্তি নিয়ে উত্তেজনায় ফ্রান্সকে সমর্থন ও সংহতি জানিয়েছেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। এতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল বলেছেন, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীন একটি বড় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সেখানে স্থিতিশীল এবং শান্তিপূর্ণ অবস্থান অর্জনের জন্য প্রয়োজন অধিক সহযোগিতা, অধিক সমন্বয় এবং কম বিভেদ। এ বিষয়ে অস্ট্রেলিয়া যে ঘোষণা দিয়েছে, তাতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বোরেল।
যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেন-অস্ট্রেলিয়ার সাবমেরিন চুক্তিকে ফরাসীরা দেখছে ‘পিঠে ছুরি মারা’ হিসেবে, রাগে ফুঁসছে তারা- কিস্তু অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার পথে কি যাবে ফ্রান্স? এ প্রশ্নের উওর এখনো পাওয়া যায়নি।
উত্তর কোরিয়া অকাস চুক্তির নিন্দা জানিয়েছে। তারা বলছে, এই চুক্তির ফলে নতুন করে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে। উত্তর কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, অকাস চুক্তি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কৌশলগত ভারসাম্যকে বিপর্যস্ত করবে। 
 যে তিনটি দেশের মধ্যে অকাস চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এরা সবাই ইংরেজি ভাষাভাষির এবং এই তিনটি দেশকে একই গোত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই চুক্তির ফলে সবচেয়ে বেশি আতংকিত চীন। ফান্স ক্ষুব্ধ হয়েছে তাদের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার অস্ত্র বাণিজ্য চুক্তি ভেঙে যাবার কারণে। অর্থাৎ এটি একেবারেই অর্থনৈতিক। কিন্তু চীন হয়েছে তাদের নিরাপত্তার ইস্যুতে। কারণ, তাদেরকে টার্গেট করেই মূলত এই চুক্তিটি সম্পাদন করা হয়েছে। এ কারণে তারা বলা যায় ‘মহাক্ষুব্ধ’। 

অকাস চুক্তি নিয়ে বিভক্ত পশ্চিমা বিশ্ব, বন্ধুত্ব ভাতৃত্ব যৌথ স্বার্থকে ছাপিয়ে গেছে অন্য কিছু
ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা যে পশ্চিমাদের জন্য স্বার্থের দ্বন্দ্ব ছাড়া কিছুই নয়, তা আবারও প্রমাণ হলো। অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্যের মধ্যকার নতুন চুক্তির ফলে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে ফ্রান্স-অস্ট্রেলিয়া সামরিক চুক্তি। যে চুক্তিবলে অস্ট্রেলিয়া ১২টি পারস্পরিক সাবমেরিন দেওয়ার কথা ছিলো ফ্রান্সের। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া এখন চায় জলের নিচে অনন্তকাল ডুবে থাকার শক্তি।
ফ্রান্স ৮টি সাবমেরিনের কাজ অর্ধেকের মতো করে ফেলেছিলো। নকশা প্রণয়ন অনেক আগেই শেষ। ফলে মাল্টি বিলিয়ন ডলারের লোকসানে পড়তে হবে দেশটিকে। তাদের ক্ষোভ শুধু অস্ট্রেলিয়ার উপরেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তারা ক্ষেপেছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের উপরেও।

ক্ষুব্ধ প্যারিস এর প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায় তাদের নিজেদের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠিয়েছে। পশ্চিমা কোনো মিত্র দেশ থেকে রাষ্ট্রদূতদের ডেকে পাঠানো খুবই অস্বাভাবিক ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া থেকে ফ্রান্স তাদের রাষ্ট্রদূতদের এই প্রথমবারের মতো ডেকে পাঠাল। ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, পরিস্থিতির ভয়াবহতার কথা বিবেচনা করেই তাদের এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যঁ ইভ লু দ্রিয়া বলেন, ‘এই চুক্তির মাধ্যমে পেছন থেকে ছুরি মারা হয়েছে। যে সমঝোতা হয়েছে তাতে মিত্র দেশ ও অংশীদারদের মধ্যে এমন আচরণের বিষয় রয়েছে যা গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের জোটসমূহের যে লক্ষ্য, অংশীদারিত্বের ওপর এর প্রভাব পড়বে’।

নবগঠিত অকাস জোটের তিনটি দেশ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে যে সমঝোতা হয়েছে তাতে পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিন তৈরির জন্য অস্ট্রেলিয়াকে প্রযুক্তি সরবরাহ করার কথা বলা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে এসব সাবমেরিন নির্মাণ করা হবে।

অস্ট্রেলিয়ার কেন এই সাবমেরিন প্রয়োজন? এশিয়ায় শক্তির ভারসাম্য পাল্টে যাচ্ছে?
অস্ট্রেলিয়া কেন মনে করছে যে তার এই সাবমেরিন পেতেই হবে?
এখানে কি শুধুই অস্ট্রেলিয়ার স্বার্থ কাজ করেছে - নাকি এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রেরও সুদূরপ্রসারী কৌশলগত হিসেব-নিকেশ কাজ করছে?
সেই হিসেব-নিকেশকে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এতটাই গুরুত্ব দিচ্ছে যে শুধু চীনের চোখ-রাঙানিকেই তারা উপেক্ষা করছে তা নয়, তাদের ন্যাটো মিত্র ফ্রান্সকেও ক্ষেপিয়ে তুলতে দ্বিধা করেনি।
চুপিসারে এবং অত্যন্ত গোপনে এ চুক্তির আলোচনাগুলো করা হয় - আর তা ঘোষণার ঠিক আগে একেবারে শেষ মুহূর্তে ফ্রান্সকে স্তম্ভিত করে অস্ট্রেলিয়া জানিয়ে দেয় - তারা ফ্রান্সের কাছ থেকে ১২টি ডিজেলচালিত সাবমেরিন কেনার জন্য করা চার হাজার কোটি ডলারের চুক্তিটি বাতিল করছে।
আমেরিকা, ব্রিটেন, ইউরোপ আর এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা একে বলছেন - এক মোড়-বদলকারী ঘটনা, যা পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত-মহাসাগরীয় অঞ্চলের কৌশলগত হিসেব-নিকেশ পাল্টে দেবে। ‘চুক্তিভঙ্গ’,‘পিঠে ছুরিকাঘাত’, ‘বেইমানি’ - এরকম কথা শুনতে হয় হোক, পারমাণবিক সাবমেরিন আমাদের লাগবেই’- অস্ট্রেলিয়ার ভাবখানা ছিল এই রকমই । কেন?
পৃথিবীতে এখন মাত্র ছয়টি দেশের হাতে পারমাণবিক সাবমেরিন আছে। এরা হলো, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও ভারত।
এর সুবিধাটা কী? সহজ কথায়, পরমাণু-শক্তিচালিত সাবমেরিন শত্রুপক্ষের চোখ এড়িয়ে গভীর সমুদ্রের নিচে ডুবে থাকতে এবং দ্রুত চলাচল করতে পারে - আর তার উপস্থিতি চিহ্নিত করাও অনেক কঠিন।
সাধারণ সাবমেরিনের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে - এগুলো হয় ডিজেল বা বৈদ্যুতিক শক্তিচালিত। ডিজেল ইঞ্জিনে জ্বালানি পোড়ানোর জন্য বাতাস দরকার, আর ইলেকট্রিক ইঞ্জিনের জন্য ঘন ঘন রিচার্জ করা দরকার।
এ কারণে সবচেয়ে উন্নত ধরনের ‘কনভেনশনাল’ সাবমেরিনও এক নাগাড়ে কয়েক দিনের বেশি পানির নিচে ডুবে থাকতে পারে না।
তাদের জ্বালানির জন্য পানির ওপর ভেসে উঠতে হয়, বা বাতাস নেবার নলটিকে পানির ওপরে ভাসিয়ে রাখতে হয়। ফলে তা শত্রুপক্ষের চোখে ধরা পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
অন্যদিকে এখন যেসব পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরি হচ্ছে - সেগুলো কোন রিফুয়েলিং ছাড়াই মাসের পর মাস পানির নিচে থাকতে পারে।
এগুলো অনেক বেশি ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে পারে, এবং তা অনেক বেশি দূর পর্যন্ত নিক্ষেপ করতে পারে।
সুতরাং পরমাণু-শক্তিচালিত সাবমেরিনের মালিক হবার পর অস্ট্রেলিয়ান সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে।
তারা অস্ট্রেলিয়ার আশপাশে প্রশান্ত মহাসাগরের বহুদূর পর্যন্ত এলাকায় গোপন নজরদারি ও টহল দিতে পারবে।
অস্ট্রেলিয়া মনে করছে, এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব ও হুমকি এতটাই বেড়ে গেছে যে তা মোকাবিলা করতে হলে ঠিক এই জিনিসটাই তাদের দরকার, ডিজেলচালিত সাবমেরিনে তাদের চলবে না।
অস্ট্রেলিয়া পারমাণবিক অস্ত্রমুক্তকরণ চুক্তিতে স্বাক্ষর দানকারী একটি দেশ। তাই তাদের পক্ষে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হওয়া বা তা মোতায়েন করা নিষিদ্ধ। সে কারণে মি. বাইডেন এবং মি. মরিসন উভয়েই বলেছেন যে অস্ট্রেলিয়া এই সাবমেরিনে পারমাণবিক অস্ত্র বহন করা হবে না।
তাই মনে করা হচ্ছে, খুব সম্ভবত এই পারমাণবিক সাবমেরিনে প্রচলিত, সাবমেরিন-থেকে নিক্ষেপযোগ্য ক্রুজ মিসাইল থাকবে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু এটি পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন- তাই এতে যদি শুধু প্রচলিত অস্ত্রই থাকে এবং এতে কোন বিদেশি ক্রু না-ও থাকে - তার পরও এটা প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় নৌ-শক্তির ভারসাম্য বদলে দিতে পারবে।
এগুলো তৈরি হবে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার এ্যাডিলেইডে, এবং এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য প্রযুক্তি ও পরামর্শ দেবে। কমপক্ষে আটটি সাবমেরিন তৈরি হবে, তবে এগুলো কোথায় মোতায়েন হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।

পারমাণবিক সাবমেরিনের জ্বালানি বোমা-তৈরির-উপযোগী ইউরেনিয়াম
আমেরিকান এবং ব্রিটিশ সাবমেরিনগুলোয় যে পারমাণবিক চুল্লি ব্যবহার করা হয়, তা খানিকটা স্নায়ুযুদ্ধের যুগের মত। এতে জ্বালানি হিসেবে যে ইউরেনিয়াম ব্যবহৃত হয়- তা পরমাণু বোমা তৈরির উপযুক্ত অতি-উচ্চস্তরের ইউরেনিয়াম।
ওয়াশিংটন অনেকদিন ধরেই এই স্তরের জ্বালানি ব্যবহার বন্ধ করে কম-বিপজ্জনক জ্বালানি চালু করতে কাজ করছে - যাতে এগুলো সন্ত্রাসীদের হাতে না পড়ে, এবং যা অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করা কঠিন।
তবে অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে খুব সম্ভবত অতিউচ্চমাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামই ব্যবহার করা হবে, বলছেন পর্যবেক্ষকরা। এতেও বোঝা যায় বিষয়টিকে কতটা গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অস্ট্রেলিয়াকে পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরি করতে দেবার মধ্যে দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের দাবিকে চ্যালেঞ্জ করতে এক বিশাল পদক্ষেপ নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
‘পারমাণবিক এ্যাটাক সাবমেরিন পাওয়া এক বিরাট ব্যাপার, এবং তা এক বিরাট বার্তা দিচ্ছে - নিউইয়র্ক টাইমসকে বলছেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক বিপিন নারাং। তিনি বলছেন, ‘পাঁচ বছর আগে এটা কল্পনা করাও কঠিন ছিল, আর ১০ বছর আগে তা ছিল অসম্ভব ব্যাপার’।
‘এবং, এ থেকে ওই অঞ্চলে চীনের আচরণ কেমন - তারও একটা আন্দাজ পাওয়া যায়’ - বলেন তিনি।
মি. বাইডেন যে অস্ট্রেলিয়ার সাথে পারমাণবিক সাবমেরিন পরিচালনা প্রযুক্তি বিনিময়ের সিদ্ধান্ত নিলেন - এর গুরুত্ব বোঝাতে একটি দৃষ্টান্ত দেয়াই যথেষ্ট।
যুক্তরাষ্ট্র এর আগে সবশেষ পারমাণবিক সাবমেরিন প্রযুক্তি বিনিময় করেছিল ১৯৫৮ সালে - এবং তা হয়েছিল ব্রিটেনের সাথে। এর পর আর কোন মিত্রের সাথে তারা এই প্রযুক্তি হস্তান্তর করেনি।

এক ‘নতুন স্নায়ুযুদ্ধ’?
ওয়াশিংটন ও লন্ডন থেকে অবশ্য বলা হচ্ছে, এই পদক্ষেপের লক্ষ্য চীন নয়। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন - অস্ট্রেলিয়াকে এ প্রযুক্তি দেয়ার পেছনে চীনকে ঠেকানো ছাড়া আর কোন কারণ থাকতে পারে না। সাবেক অস্ট্রেলিয়ান প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা অধ্যাপক হিউ হোয়াইট বলছেন, এক নতুন স্নায়ু যুদ্ধের কথা।
‘এর মধ্যে দিয়ে এই অনুভূতি গভীর হচ্ছে যে এশিয়াতে সত্যি এক নতুন স্নায়ুযুদ্ধ হচ্ছে, এবং তাতে যুক্তরাষ্ট্রই জিতবে বলে অস্ট্রেলিয়া বাজি ধরেছে’ - বলছেন তিনি। ‘চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত ব্যবস্থার সাথে অস্ট্রেলিয়া যুক্ত, এবং এটা হলো তাকে আরো গভীর করার এক সিদ্ধান্ত’।
এটা এক বিরাট চুক্তি - কারণ এই তিনটি দেশ ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ মোকাবিলার জন্য কাজ শুরু করলো’, -বলছিলেন অস্ট্রেলিয়ার নর্দার্ন টেরিটরি সরকারের প্রতিরক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক সিনিয়র পরিচালক গাই বোকেনস্টাইন।
চুক্তিটিতে এই তিন দেশের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য এবং কোয়ান্টাম প্রযুক্তি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তথ্য ও প্রযুক্তি বিনিময়ের কথাও আছে - তবে মূল জিনিসটি হলো পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিন। তা ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার কাছে বিক্রি করা হবে টোমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র।
চীনকে ঠেকাতে একের পর এক পদক্ষেপ নিচ্ছেন বাইডেন।
বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব খর্ব করতে একের পর এক পদক্ষেপ নিচ্ছেন - অর্থনৈতিক, সামরিক এবং প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে।
গত আট মাসে চীন যেন সেমিকাকটর সামগ্রীর মত কিছু উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি হাতে না পায় - সেই পথ বন্ধ করেছে বাইডেন প্রশাসন। এ ছাড়া তারা হুয়াওয়েকে প্রত্যাখ্যানের জন্য বিভিন্ন দেশকে আহ্বান জানিয়েছে, তাইওয়ানের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে, হংকংএ চীনের পদক্ষেপের নিন্দা করেছে।
মি. বাইডেন নিজে গত সপ্তাহে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংএর সাথে ফোনে কথা বলেছেন। নব্বই মিনিটের এ আলাপের বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়েছে খুবই কম।
অবশ্য এ বৈঠকের সময় অস্ট্রেলিয়ার জন্য পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরি করার প্রসঙ্গ আগাম ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল কিনা - তা জানা যায়নি।
এ সপ্তাহেই তিনি ‘কোয়াড’-এর নেতাদের সাথে এক বৈঠক করছেন -যাতে থাকবেন জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার নেতারা - যা একসাথে মিলে বেজিংএর মোকাবিলা করার আরেকটি ইঙ্গিত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তাদের মতে - যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে বেরিয়ে আসার পর এবং ব্রিটেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার পর তারা একসাথে মিলে চীনের হুমকি এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ব্যাপারে আরো মনোযোগী হতে চাইছে।
আর অস্ট্রেলিয়া ওই অঞ্চলে চীনের প্রভাব বাড়তে থাকায় ক্রমশঃই আরো বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিল, তাই এখানে অভিন্ন স্বার্থের মিলন ঘটেছে।
অস্ট্রেলিয়ার স্ট্রাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউটের প্রতিরক্ষা কৌশল ও জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক পরিচালক ইকেল শুব্রিজ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন ওই অঞ্চলে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপিন, ভারত ও ভিয়েতনামের সাথে বিভিন্ন অংশীদারিত্বে বিপুল বিনিয়োগ করছে, এবং এই চুক্তি তাদের সবার জন্য লাভজনক হবে।
তার মতে. তাইওয়ানের প্রতি হুমকি, হংকংএর ঘটনাবলী, দক্ষিণ চীন সাগরের সামরিকীকরণ - এর প্রেক্ষাপটে চীনের বিরুদ্ধে কৌশলগত ডেটারেন্ট গড়ে তোলার প্রয়োজন সহজেই বোঝা যায়।

চীন-অস্ট্রেলিয়া সম্পর্ক কেন খারাপ হলো?
চীন ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে বড় বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব আছে এবং বহু চীনা ছাত্র অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করে। কিন্তু এ সাবমেরিন চুক্তির পর ‘অস্ট্রেলিয়া এখন নিজেকে চীনের বৈরী দেশে পরিণত করেছে’- মন্তব্য করেছে চীনের গ্লোবাল টাইমস দৈনিক। করোনাভাইরাস মহামারির উৎস সন্ধানের এক বৈশ্বিক তদন্তে অস্ট্রেলিয়া সমর্থন দেবার পরই দুদেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হয়। এরপরই দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিত্রতা গভীরতর করতে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া।
‘পারমাণবিক সাবমেরিন পেলেই অস্ট্রেলিয়া যে চীনের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে যাবে তা নয়’, - বলছেন ইউ সান, ‘তবে এতে ওই অঞ্চলের ক্ষমতার ভারসাম্য পাল্টে যাচ্ছে’।
নবগঠিত অকাস জোটের তিনটি দেশ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে যে সমঝোতা হয়েছে তাতে পরমাণু শক্তি-চালিত সাবমেরিন বা ডুবোজাহাজ তৈরির জন্য অস্ট্রেলিয়াকে প্রযুক্তি সরবরাহ করার কথা বলা হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার জন্য সাবমেরিন নির্মাণের পাশাপাশি গোয়েন্দা ও কোয়ান্টাম প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তথ্য ও প্রযুক্তি বিনিময়ের কথা বলা হয়েছে এই চুক্তিতে। উল্লেখ্য যে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় উদ্বিগ্ন ছিলো অস্ট্রেলিয়া।
নতুন এই জোট গঠনের ঘোষণা যে সময়ে দেওয়া হয়েছে সেটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আফগানিস্তানে দুই দশকের যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণার ঠিক এক মাস পরেই অকাসের কথা ঘোষণা করা হলো।
দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে তা নিয়ে অনেকের মধ্যে যখন সন্দেহ তৈরি হচ্ছিল তখনই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তার দুটি মিত্র দেশকে পাশে নিয়ে নতুন এই জোটের ঘোষণা দেওয়া হলো।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা দাবি করছেন যে চীনকে টার্গেট করে অকাস জোট গঠন করা হয়নি।

কেন ক্ষুব্ধ ফ্রান্স
নৌযান নির্মাণশিল্প নিয়ে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোর মধ্যে একধরনের বিরোধ বেশ আগে থেকেই রয়েছে। এরই মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার নতুন করে চুক্তি বদলে ফেলার ঘটনাকে নাটকীয় বলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিশ্বের বড় বড় অস্ত্র রপ্তানি চুক্তির মধ্যে এটি অন্যতম।
২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ফ্রান্সের নৌযান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নেভাল গ্রুপের কাছ থেকে তারা নতুন সাবমেরিন তৈরি করে নেবে। নতুন এই সাবমেরিন প্রতিস্থাপিত হবে পুরোনো কলিন্স সাবমেরিনের জায়গায়।
এ ছাড়া দুই সপ্তাহ আগেও অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বলেছিলেন, তাঁরা ফ্রান্সের কাছ থেকেই এই সাবমেরিন তৈরি করে নেবেন। এ ছাড়া গত জুনে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন যখন ফ্রান্সে গিয়েছিলেন, তখন দেশটির প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁও দুই দেশের ভবিষ্যৎ সাহায্য-সহযোগিতার কথা বলেছিলেন। কিন্তু দুই সপ্তাহের ব্যবধানে হঠাৎ সিদ্ধান্ত বদলে ফেলল অস্ট্রেলিয়া।
এ প্রসঙ্গে ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এর মাধ্যমে পেছন থেকে ছুরি মারা হয়েছে। আমরা অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে একটি বিশ্বাসের সম্পর্ক স্থাপন করেছিলাম। অস্ট্রেলিয়া সেই বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রবিষয়ক বিবিসির সংবাদদাতা বারবারা প্লেট-আশার বলছেন, অকাস চুক্তিটি ফ্রান্সের জন্য একদিকে অর্থনৈতিক ধাক্কা। তেমনি নতুন এই নিরাপত্তা চুক্তির ঘোষণা ফরাসি নেতাদের জন্য বিস্ময়করও, কারণ এ বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা ছিল না। নতুন এই জোট গঠনের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ফ্রান্সকে এ বিষয়ে অবহিত করা হয়।
বারবারা প্লেট-আশার বিবিসির ওয়েবসাইটে এই ঘটনার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে পাঠানোর ঘটনা সম্ভবত নজিরবিহীন। আমেরিকার প্রাচীনতম বন্ধু ফ্রান্স। হোয়াইট হাউজের কর্মকর্তারাও একথা উল্লেখ করেছেন।’
ফ্রান্স বলছে, অর্থনৈতিক কারণে তারা ক্ষুব্ধ হয়নি। তাদের ক্ষোভের পেছনে কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা-জনিত কারণও রয়েছে।
প্যারিস থেকে বিবিসির সংবাদদাতা হিউ স্কফিল্ড বলছেন, প্যারিসে এলিজে প্রাসাদ উদ্বিগ্ন একারণে যে ওয়াশিংটন, ক্যানবেরা এবং লন্ডনের কর্মকর্তারা তাদের ক্ষোভের কারণকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করছেন এবং তাদেরকে ছোট করে দেখছেন।’
‘ফ্রান্স বলছে সাবমেরিন চুক্তির কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে বলে তারা ক্ষুব্ধ হয়নি। বরং মিত্র দেশ হওয়া সত্ত্বেও, যেভাবে ফ্রান্সকে এই দৃশ্যের বাইরে রেখে ইংরেজিভাষী তিনটি দেশের মধ্যে গোপনে আলাপ আলোচনা হয়েছে তাতে তারা ক্ষুব্ধ।’
অকাসের তিনটি দেশের প্রত্যেকটির সাথেই ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক রয়েছে ফ্রান্সের। বিশেষ করে আফ্রিকার সাহের অঞ্চল ও আফগানিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসবাদ দমনে তারা এই তিনটি দেশের সাথে কাজ করেছে।

চীন মহাক্ষুব্ধ, কারণ কি?
চীন অস্ট্রেলিয়ার বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। কিন্তু অকাস চুক্তির ফলে এই দুটি দেশের সম্পর্ক যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। চুক্তির তীব্র সমালোচনা করে চীন একে ‘চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন’ ও ‘সংকীর্ণ মানসিকতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আধিপত্য মোকাবিলার অংশ হিসেবে এই চুক্তিকে দেখা হচ্ছে। চীন অন্যায়ভাবে দক্ষিণ চীন সাগরকে তাদের বলে দাবি করছে বলেও বলা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে আবার বক্তব্য দিয়েছে চীন। তারা বলেছে, দক্ষিণ চীন সাগর তাদেরই। তা নিজেদের বলে দাবি করার কিছু নেই।
সানডে টেলিগ্রাফে প্রকাশিত এক লেখায় অকাস চুক্তির পক্ষে অবস্থান পরিষ্কার করেছেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রুস। তিনি বলেছেন, এতে ব্রিটেনের স্বার্থ রক্ষার বিষয় আছে। ওদিকে এই চুক্তির ফলে বিশ্বে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিনের দিক দিয়ে অস্ট্রেলিয়া হবে সপ্তম দেশ।
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাঁও লিজিয়ান বলেছেন, এই জোট আঞ্চলিক শান্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার ঝুঁকি তৈরি করেছে এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে জোরদার করছে।
যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়া- এই তিনটি দেশের তীব্র সমালোচনা করেছেন তিনি। এবং অকাস চুক্তিকে ‘স্নায়ু যুদ্ধ মানসিকতা’ উল্লেখ করে বলেছেন, তারা তাদের নিজেদের স্বার্থেরও ক্ষতি করছে। চীনা গণমাধ্যমগুলোতেও একই মনোভাব ব্যক্ত করে সম্পাদকীয় প্রকাশ করা হয়েছে।
চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের সম্পাদকীয়গুলোতে এ চুক্তির নিন্দা করা হয়। গ্লোবাল টাইমস-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, অস্ট্রেলিয়া এখন নিজেকে চীনের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ চীন সাগরে বিরোধপূর্ণ জায়গাগুলোতে উত্তেজনা ছড়ানোর জন্য বেইজিংকে দায়ী করে আসছিলো পশ্চিমারা। চীন ওই অঞ্চলে তার শতবর্ষ পুরাতন অধিকার আছে বলে দাবি করছে এবং এর পক্ষে সামরিক উপস্থিতি বাড়াচ্ছিলো। যুক্তরাষ্ট্রও তার মিত্র দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের স্বার্থ সুরক্ষায় সামরিক উপস্থিতি জোরদার করেছে। অস্ট্রেলিয়ায় সাবমেরিন স্টেশন থাকা মানে ওই অঞ্চলের যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা, বলছেন বিশ্লেষকরা। এই চুক্তি চীনকে যুদ্ধের দিকে উস্কে দিতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে।

চীনকে শায়েস্তা করতেই ‘অকাসে’!
সরাসরি চীনকে মোকাবিলার কথা না বলা হলেও তিন দেশের নতুন জোট ‘অকাসে’র মূল উদ্দেশ্যই চীনের আধিপত্য হ্রাস করা। ইন্দো প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এই জোট বলয় বাড়িয়ে বেইজিংকে কোণঠাসা করতে চাইবে এটাই সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ, বলছেন বিশ্লেষকরা।
গেল ৬০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো নিজেদের সাবমেরিন প্রযুক্তি অন্যদের দিতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে কেবল যুক্তরাজ্যকেই এই প্রযুক্তি দেয় তারা। চীনকে প্রতিহত করতে অস্ট্রেলিয়াকে নতুন অস্ত্র হিসেবে গড়ে তোলাই এখন ওয়াশিংটনের লক্ষ্য। 
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রেসিডেন্ট এই তো কদিন আগেই টেলিফোনে কথা বলেন। তাদের কথায় উঠে আসে, তারা কোনো যুদ্ধে জড়াতে চান না। দুই দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতা রয়েছে নানা বিষয়ে, তবে কোনো বিষয়ই যেন সংঘাতের অংশ হয়ে না যায়, তা নিয়েই সচেতন ছিলেন দুই প্রেসিডেন্ট। তবে এর কদিন বাদেই চীনকে চেপে ধরতে নতুন কৌশলে গেল যুক্তরাষ্ট্র। সঙ্গী যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া। এ নিয়েই এখন জোর আলোচনা।
ইন্দো প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তিন দেশের সাবমেরিন চুক্তি আগামীতে নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। পক্ষান্তরে চীন এখন আরও বেশি শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করবে।
জ্যেষ্ঠ আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা গবেষক ড. টিমোথি হেথ বলেন, ইন্দো প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বারাক ওবামা প্রশাসনের সময় থেকেই তীক্ষè নজর যুক্তরাষ্ট্রের। কারণ এই অঞ্চলটি এখন বিশ্ব অর্থনীতির বড় অংশ। কিন্তু এইখানে চীন তার আধিপত্য বাড়াচ্ছে। এটিকে নতুন করে টেক্কা দিতেই চুক্তিটি হয়েছে।
কূটনৈতিক লেখক মেথিউ লি বলেন, চীনের আগ্রহের বিষয়ই এখন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেইজিংকে ধরাশাই করাই ওয়াশিংটনের মুখ্য উদ্দেশ্য।
এদিকে, তিন দেশের জোট ঘোষণার একদিন পরেই এশিয়া-প্যাসিফিক বাণিজ্য জোট ‘কম্প্রিহেনসিভ অ্যান্ড প্রোগ্রেসিভ এগ্রিমেন্ট ফর ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ’ (সিপিটিপিপি)তে যোগ দেওয়ার আনুষ্ঠানিক আবেদন করেছে চীন। জোটটিতে যোগ দিলে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তারের পথ সুগম হবে বলে ধারণা অনেক পর্যবেক্ষকের।
উল্লেখ্য, বেইজিংয়ের প্রভাব রুখতেই বারাক ওবামার আমলে যুক্তরাষ্ট্রই প্রথম এই এশিয়া-প্যাসিফিক বাণিজ্য জোটের উদ্যোগ নিয়েছিল। এরপর সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৭ সালে এই উদ্যোগ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেন। পরে জাপানের নেতৃত্বে সিপিটিপিপি গঠনের আলোচনা শুরু হয়। ২০১৮ সালে ১১টি দেশ এতে স্বাক্ষর করে।

 (সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ প্রকাশিত)